একসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী জয়নাল হাজারীর নীরব প্রস্থান

নিজস্ব প্রতিবেদক

একসময় দোর্দণ্ডপ্রতাপের সঙ্গে কাঁপিয়েছেন ফেনীর রাজনৈতিক অঙ্গন। এক জেলা, এক নেতা মূলমন্ত্রের প্রয়োগ করতে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন জেলাটির একাধিপতি। আবার ক্ষমতার চূড়া থেকে পতনের পর রাজনীতির প্রকাশ্য ময়দান থেকে হারিয়ে যেতেও সময় নেননি। চিকিৎসাও করাতে হয়েছে দল থেকে অনুদান নিয়ে। শেষ পর্যন্ত পাদপ্রদীপের আড়ালে থেকেই নীরবে বিদায় নিলেন জয়নাল আবেদিন হাজারী। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি...রাজেউন) তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

জীবনের শেষ দিনগুলোয় মূলত নিজ মালিকানাধীন হাজারিকা প্রতিদিন পত্রিকার প্রকাশনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জয়নাল হাজারী। নিয়মিত ফেসবুক লাইভেও আসতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রোগব্যাধিতে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। চিকিৎসার খরচ মেটাতে ছুটতে হতো এখানে-সেখানে। সর্বশেষ করোনার আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৪০ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান পেয়েছিলেন তিনি।

একসময় নিয়মিত সংবাদপত্রের শিরোনাম হতেন জয়নাল হাজারী। সাংবাদিক পেটানো, হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ নানা ইস্যুতেই তার নামে খবর প্রকাশ হতো নিয়মিতভাবে। পরিচিতি পেয়েছিলেন ফেনীর একচ্ছত্র গডফাদার হিসেবে। ২০০১ সাল পর্যন্ত চলে তার রাজত্ব। এরপর তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়েন জয়নাল হাজারী। হারিয়ে ফেলেন ফেনীর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও। সেই থেকে নিজ জেলা ফেনী তার কাছে হয়ে উঠেছিল দূরের জনপদ। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটিতে ঠাঁই পেলেও রাজনীতিতে খুব একটা সরব হয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

কভিডের আগে ২০১৯ সালে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন জয়নাল হাজারী। ওই সময় রাজনীতিতে প্রভাবহীন হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করে বণিক বার্তাকে তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে এখন আমার প্রভাব নেই। জনপ্রিয়তাও নেই।

ফেনীতে থাকাকালে তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল জেলার মাস্টারপাড়ার ভবন শৈল কুঠির। তবে জয়নাল হাজারী অন্তরালে চলে যাওয়ার পর শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল বাড়িটিও। জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছিল সীমানা প্রাচীর। এক পাশে গড়ে উঠেছিল ঝোপঝাড়। বাড়ির ভেতরে জমেছিল ধুলোবালি। আনাগোনা ছিল না লোকজনেরও। অথচ বাড়িতেই একসময় স্টিয়ারিং কমিটির নিয়মিত বৈঠক বসত। কমিটির হাতেই নিয়ন্ত্রণ হতো পুরো ফেনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন জয়নাল হাজারী। নিজের দোর্দণ্ডপ্রতাপের সময়টায় বাড়িতেই নিয়মিত বৈঠক করতেন তিনি। বাড়ি ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিশাল কর্মযজ্ঞ। দলে দলে মানুষ হাজারীকে কুর্ণিশ করত। তাদের মধ্যে ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। গত বছর বাড়িটির কিছু মাত্রায় সংস্কার করা হলেও ফিরে আসেনি তার রমরমা ভাব। বাড়িটির অবস্থাকে অনেকটা জয়নাল হাজারীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেরই রূপক প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখেছেন ফেনীর স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা জানান, ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট বাড়িটিতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। তার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ফেনীর সবকিছু। জেলাটিতে সবকিছু হতো তার ইশারায়ই।

বর্ণাঢ্য রাজনীতির অধিকারী জয়নাল হাজারী রাজনীতি করেছেন ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্রাবস্থায় ফেনী কলেজে তত্কালীন ছাত্র মজলিশের (বর্তমান ছাত্র সংসদ) জিএস ছিলেন তিনি। এরপর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যপদেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে ফেনীর রাজনীতিতে তার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা শুরু মূলত আশির দশকে।

১৯৮৬ সালে প্রথম তিনি ফেনী- আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৮৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ওই সময় থেকেই ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব ছিল তার হাতে। এরপর ১৯৯১ সালে দুটি আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন ফেনী- আসন থেকে। দলে নিজের একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখতে ১৯৯৩ সালে গঠন করেন স্টিয়ারিং কমিটি। ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে বছর স্টিয়ারিং কমিটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ক্লাস কমিটি

জেলার ৪৩টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিল প্রায় ১৫ হাজার। কমিটি একসময় ফেনীর মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠে। চার খলিফার মাধ্যমে এসব কমিটি পরিচালনা করতেন হাজারী। সেই চার খলিফা হলেন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের তত্কালীন সভাপতি আজহারুল হক আরজু, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সাজু, সহসভাপতি শাখাওয়াত হোসেন তত্কালীন পৌর যুবলীগ সভাপতি একরামুল হক একরাম। তাদের মধ্যে একরামুল হককে ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয়। আজহারুল হক আরজু শাখাওয়াত এক পর্যায়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। শাহজাহান সাজু ভিড়ে যান নিজাম হাজারীর দলে।

২০০১ সালের ১৭ আগস্ট তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গভীর রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সেলফোনের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে তল্লাশি চালানো হয় জয়নাল হাজারীর মাস্টারপাড়ার বাড়িতে। তার আগেই পালিয়ে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৮টি মামলা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় ৮৫ বছরের সাজাও হয় তার। ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করলে হাজারী আট সপ্তাহের জামিন পান। একই বছরের ১৫ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় চার মাস কারাভোগের পর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মুক্ত হন তিনি।

কোটি ১৩ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করায় ২০০৮ সালে নিম্ন আদালত জয়নাল হাজারীকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। পরে হাইকোর্ট তার সাজা বাতিল করেন। এরপর একে একে সব মামলা থেকে খালাস পান তিনি। কিন্তু হারানো রাজনীতির মাঠ আর ফিরে পাননি। দশম জাতীয় নির্বাচনে নিজাম হাজারী আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ফেনীর রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন জয়নাল হাজারী। পরে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পান তিনি। যদিও রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে আর জানান দিতে পারেননি তিনি।

ফেনীতে প্রতাপশালী থাকা অবস্থায় তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন সাংবাদিক টিপু সুলতানের ওপর হামলার ঘটনায়। বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০০১ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক টিপু সুলতানকে অপহরণ করে হাত-পা ভেঙে দেয়ার অভিযোগ ওঠে জয়নাল হাজারীর অনুগত ক্যাডারদের ওপর। ওই সময় ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়।

ওই সময় আরো দুটি আলোচিত ঘটনা হলো সোনাগাজীর চর ইঞ্জিমান ট্র্যাজেডি পূর্ব চন্দ্রপুর ট্র্যাজেডি। চর ইঞ্জিমানে বিএনপি, যুবদল ছাত্রদলের ১০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে হত্যার পর মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। পূর্ব চন্দ্রপুরে ট্রিপল মার্ডারেরও আসামি ছিলেন জয়নাল হাজারী। পরে মামলায় খালাস পান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন