নদীকে অবহেলা করে কোনো দেশ উন্নত হতে পারেনি

কমডোর গোলাম সাদেক বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান পদে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮৯ সালের জুলাই তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। বিআইডব্লিউটিএর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নিজের অভিজ্ঞতা সংস্থাটির কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন

দেশে যোগাযোগ বাণিজ্য পরিবহন ব্যবস্থা এক সময় নৌপথকেন্দ্রিক ছিল। নৌপথে সুদিন ফিরিয়ে আনতে বিআইডব্লিউটিএর কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি?

নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাণিজ্য যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নৌপথকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের নদীপথগুলো মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম হওয়ায় আমরা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছি। যেহেতু সড়ক রেলপথের সংখ্যা বেড়েছে, তাই নদীপথে যাতায়াত কোথাও কোথাও কমে এসেছে। কিন্তু নদীপথের গুরুত্ব এখনো আগের মতোই আছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো নদীকেন্দ্রিক। তবে আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রচুর পলি আসায় নৌপথের ব্যবহার কমে গেছে। আশার কথা হলো বর্তমান সরকার ড্রেজিং পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে নৌপথের সুদিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে যথেষ্ট অর্থ ব্যয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে তা সড়ক রেলপথের চেয়ে অনেক কম, তাতে সন্দেহ নেই।

-দ্বীপ পরিকল্পনায় বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগের কথা ভাবছে সরকার। এতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কী ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?

বিশ্বের বৃহত্তম -দ্বীপ বাংলাদেশের অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারে নদীকেন্দ্রিক। আমরা বিভিন্ন সময় নদীকে অবহেলা করেছি, যার কারণে নদীভিত্তিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারিনি। এখন সরকার ১০০ বছরের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়ন করা হলে উন্নত দেশ হয়ে ওঠার পথে সহায়ক হবে। -দ্বীপ পরিকল্পনার সুবিধা হলো, এটি বাস্তবায়নের অর্থ একদিনে সংকুলান করতে হবে না, পর্যায়ক্রমে করতে হবে; ফলে এটির সুবিধা ভোগ আরো সহজ সাশ্রয়ী হবে। মনে রাখতে হবে, নদীভিত্তিক অর্থনীতি, নদীভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা একটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদীকে অবহেলা করে কোনো দেশ উন্নত হতে পারেনি। 

নদ-নদীর ওপর নির্মিত সেতুর উচ্চতার নৌ-পরিবহনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি রুটে নৌচলাচল বন্ধও রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ কিংবা নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এককভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এর সঙ্গে সড়ক রেল বিভাগেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কম উচ্চতার সেতু নৌচলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে যেসব ব্রিজ তৈরি হবে, বিআইডব্লিউটিএর নির্ধারিত উচ্চতা মেনে নির্মাণ হবে। যেসব জায়গায় সেতু তুলনামূলকভাবে বেশি নিচু, সেখানে তা প্রতিস্থাপনের চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। তবে এর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। ঢাকার চারপাশে ১৭টি নিচু সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি পরিকল্পনা চলছে। আশা করছি, আগামী ১০-১২ বছরে চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে।

সরকারি-বেসরকারি একাধিক সংস্থা সরাসরি নদী রক্ষায় কাজ করা সত্ত্বেও নদী দখল-দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন?

এজন্য আসলে আমাদের অসচেতনতা দায়ী। একশ্রেণীর মানুষের কারণে আমাদের নদীগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি রোধ করতে ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামষ্টিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে দূষণ রোধ করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। খালগুলো নিয়ে সিটি করপোরেশন কাজ করছে। ঢাকার মেয়ররা নদী খালের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন, সরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান ধরে এগোচ্ছেআশা করছি কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে দেশের নদ-নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদ-নদী দূষণমুক্ত করা যাচ্ছে না কেন?

ঢাকার গোড়াপত্তন হয়েছে বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে। তবে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বালু তুরাগও ঢাকার প্রধান নদী। পাঁচটি নদী নিয়ে ২০১৯ সালে সরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান করেছিল। ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় ছিল নদীগুলোর দখল রোধ সীমানা চিহ্নিত করা। কাজগুলো আমরা প্রায় করে ফেলেছি। বর্তমানে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সীমানা পিলার নির্মাণ, বনায়ন করার কাজও এগিয়ে চলছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ মোট পাঁচটি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। আমাদের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ বছর। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী যদি সঠিকভাবে কাজ শেষ করা যায়, সাধারণ মানুষও যদি আমাদের সহযোগিতা করে, তাহলে আমরা আশা করছি ভালো একটা ফলাফল পেতে পারব।

নদীতে দখল উচ্ছেদের পর ফের দখল হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার কী?

ঢাকার চারপাশের নদীতে উচ্ছেদের পর ফের দখলের চিত্র খুব একটা দেখা যায় না। যদিও হয় বাজার কিংবা কিছু অস্থায়ী স্থাপনা দেখা যায়। কিন্তু স্থায়ী অবকাঠামো এখানে নেই। যেহেতু আমরা দখল উচ্ছেদ করে সীমানা পিলার স্থাপন করে দিয়েছি এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণ করেছি, ফলে এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।

রাজধানীর চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ প্রকল্পটি বেশ পুরনো। এখনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন?

আমাদের দরকার ছিল নাব্যতা বৃদ্ধি করে ল্যান্ডিং স্টেশন স্থাপন। যেন নৌযানগুলো ঘাটে ভিড়তে পারে। সেগুলো করে দিয়েছি। মানুষ এখন আংশিকভাবে সুবিধা ভোগ করছে। পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হলে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে ভালো ভালো নৌযান নিয়ে যদি তারা নামেন, গতি সেবার মান ভালো হয়, অবশ্যই মানুষ এসব নৌপথে যাতায়াত করবেন। এখনো মানুষ সদরঘাট থেকে আশুলিয়ার দিকে যাতায়াত করেন। কিন্তু এসব ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা লঞ্চ মালিকদের বলছি, আপনারা ভালো নৌযান নিয়ে নামেন। আপনাদের সব ধরনের ব্যবস্থা বিআইডব্লিউটিএ থেকে দেয়া হবে।

কিন্তু ওয়াটার বাস তো তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

জনপ্রিয় হয়ে না ওঠার কারণ হলো ব্যবস্থাপনা। কেউ যদি সার্বিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারেন, মানুষকে সেবা দিতে পারেন এবং একে যদি সাশ্রয়ী করা যায়, তাহলে অবশ্যই মানুষ সেবা নিতে আগ্রহী হবে। এতে সড়কের যানজটও অনেকাংশে কমে যাবে। এখন তো গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসতে বিশাল যানজট থাকে। পুলিশ প্রশাসনও আমাদের অনুরোধ করেছে, নৌপথটা যেন ব্যবহার করা যায়। আমরা নাব্যতা বৃদ্ধি করেছি, নৌপথটি ব্যবহারোপযোগীও করেছি।

বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজের সক্ষমতা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। বিষয়ে আলাদা কোনো পরিকল্পনা আছে?

অবশ্যই আছে। এক্ষেত্রে সরকারের একার পক্ষে সব করা সম্ভব নয়। আপনারা দেখেছেন, সম্প্রতি ডুবে যাওয়া ফেরি আমানত শাহ উদ্ধারে আমরা বেসরকারি মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়েছি। যেহেতু এখন নৌযান বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমরা ২০০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ কেনার পরিকল্পনা নিয়েছি। এছাড়া আমাদের ডুবুরিদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আলাদা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। নৌবাহিনীর সেলভেজ টিমও আমাদের নানা সময় সহযোগিতা করে থাকে।

নৌদুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটি কর্তৃক নানা সুপারিশ করা হয়। সেগুলো পরবর্তী সময়ে আর মানা হয় না। ফলে দেখা যায়, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। সম্পর্কে কিছু বলুন।

অনেক সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়েছে। এর ফলেই আমরা আধুনিক নৌযান নামিয়েছি। প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছি। তদারকি বৃদ্ধি করেছি। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমরা নৌপুলিশ পেয়েছি। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর প্রাপ্ত সুপারিশগুলো নিয়ে আমরা বসি এবং প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করি।

আপনাদের ড্রেজিং কার্যক্রম সম্পর্কে বলুন। বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌপথগুলোর বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে কি?

গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়ে যাওয়া আড়াই হাজার কিলোমিটার নৌপথ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সব মৌসুমে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল রাখার বিষয়টি ছিল। এখন চার হাজার কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে আমাদের। আরো হাজার কিলোমিটার ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। কিছু নৌপথ আছে, যেগুলো দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর মানের, সেগুলো পর্যায়ক্রমে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করা হবে। প্রকল্পগুলো চালু আছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সব মৌসুমে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চালু রাখা।

অবৈধ ড্রেজিং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কি বিআইডব্লিউটিএ কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাচ্ছে?

কাটার সাকশন সুয়িং ড্রেজার ছাড়া আমাদের এখানে ড্রেজিং করা নিষেধ। আমরা আইন করে এটা নিষিদ্ধ করেছি। তবুও কোথাও কোথাও আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর একার পক্ষে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় মানুষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। বালুমহালে সুয়িং ড্রেজিং নিশ্চিত করা হলে অবৈধ ড্রেজিং বন্ধ হবে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

বিআইডব্লিউটিএর লোকবলস্বল্পতার কথা প্রায়ই উঠে আসছে। সমাধানে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি?

স্বল্পতার কারণে সব জায়গায় লোকবলের সংস্থান করা যায় না। এখন আমাদের ১১টা ড্রেজার বেজ হচ্ছে। গেজেটভুক্ত নদীবন্দরের সংখ্যা ৩৬। আমরা সরকারের কাছে লোকবল নিয়োগের চাহিদা দিয়েছি। নতুন নিয়োগের মাধ্যমে লোকবল স্বল্পতার সমস্যা কেটে যাবে বলে আশা করছি।

নদী দখল-দূষণ রোধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কম কেন?

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে খুব একটা উল্লেখ নেই। তাছাড়া পারিবারিক সামাজিক পরিমণ্ডলেও নদীকে বাঁচানোর পাঠ আমরা পাই না। শৈশব থেকেই নদীকে বাঁচানো নদী রক্ষার বিষয়টি মানুষের মনে গেঁথে দেয়া উচিত। আমি মনে করি, নদীর বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। তাহলেই আমরা নদীকে ভালোবাসতে শিখব।

নৈতিকতা সততার স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি আপনি শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। বিষয়ে কিছু বলুন।

আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, কাজ করছি কারণেই হয়তো নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা শুধু আমার অর্জন নয়, বিআইডব্লিউটিএর প্রত্যেক সদস্যের। আমি শুধু দিকনির্দেশনা দিয়েছি, তারা কাজ করেছে। মাঠে থেকে কঠোর পরিশ্রম করেছে। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ বাস্তবায়ন করেছে। আমরা উচ্ছেদ অভিযানে গিয়েছি, সততার পরিচয় দিয়েছি, কোথাও নত হইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সচিব পাশে ছিলেন বলেই আমরা ভালো করতে পেরেছি এবং শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি। আশা করি, আগামী বছরও আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন