স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ প্রস্তাব

বাস্তবায়নে লক্ষ্যাভিমুখী পদক্ষেপ নিক জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টোকিও নিউট্রিশন ফর গ্রোথ (এনফোরজি) সামিট ২০২১- প্রধানমন্ত্রী করোনায় জনস্বাস্থ্য পুষ্টির ক্ষতি মোকাবেলায় পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবগুলো হলো পুষ্টি কর্মসূচিতে করোনার প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একসঙ্গে কাজ করা, উচ্চফলনশীল পুষ্টিকর খাবার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গবেষণায় সহযোগিতা বৃদ্ধি, জরুরি বিপর্যয়ে আঞ্চলিক বৈশ্বিক পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য ব্যাংক গঠন, খাদ্যে পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধির জন্য সর্বোত্তম অনুশীলন দক্ষতা বিনিময় এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জলবায়ু অভিযোজন তহবিল বিতরণ জলবায়ুর দ্বারা সংঘটিত দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার পদক্ষেপ। আলোচ্য প্রস্তাবগুলো সময়োপযোগী বটে। প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশও প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতিতে আরো সক্রিয় হবে।

অপুষ্টি বাংলাদেশে এখনো অন্যতম বড় জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। চলমান কভিড পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জ আরো বাড়িয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা খর্বকায়তায় ভুগছে ৩১ শতাংশ। শতাংশ ভুগছে তীব্র অপুষ্টি বা কৃশতায়। বয়স অনুপাতে কম ওজন ২২ শতাংশ শিশুর। এছাড়া ৪০-৪২ শতাংশ শিশু নারী আয়োডিনস্বল্পতায় ভুগছেন। রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন নারীদের একটা অংশ। এগুলো অপুষ্টিরই নানা প্রকাশ। অপুষ্টি দূরীকরণে প্রতি অর্থবছরই খাতে বিপুল বরাদ্দ রাখে সরকার। নানা প্রকল্পের আওতায় অর্থ খরচ হচ্ছে। তবে বার্ষিক বরাদ্দের ৯৮ শতাংশই পুষ্টিসংক্রান্ত সভা, সেমিনার, প্রচার-প্রচারণা প্রশিক্ষণের মতো পরোক্ষ কার্যক্রমে ব্যয় হচ্ছে; যা দুঃখজনক। ফলে জনসাধারণের পুষ্টিনিরাপত্তায় আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। অবস্থায় প্রত্যক্ষ কার্যক্রমেই বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশ্বনির্ধারিত আটটি পুষ্টিনির্দেশিকার মধ্যে বাংলাদেশ মাত্র দুটিতে সঠিক অবস্থানে আছে বলে জানা যায়। যদি খর্বকায় কম ওজনের শিশু এক বন্ধনীতে ফেলা যায়, তাহলে বাংলাদেশে অপুষ্টিজনিত অবস্থার উন্নতি খুব একটা হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায় না। তাছাড়া নারীদের রক্তশূন্যতা, বয়স্কদের ডায়াবেটিস শুধু স্তন্যপান ইত্যাদি ক্ষেত্রে খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। ভয়ংকর সংবাদ হচ্ছে ভাতকেন্দ্রিক ভোগের কারণে নারীদের প্রায় অর্ধেক রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত; ভিটামিন মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাব পরিস্থিতিকে নাজুক করেছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কিছু অর্জনের কথা উঠে এসেছে। বিশেষ করে প্রাথমিক মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গসমতা, নবজাতক অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুহার হ্রাস, মাতৃমৃত্যু কমানো, টিকাদানের ব্যাপ্তি বাড়ানো, সংক্রামক রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতির কথা বলা হয়েছে। অথচ পুষ্টি খাতে উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো বিভিন্ন বয়স-শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বহুমাত্রিক অপুষ্টিতে ভুগছে। এর পেছনে নানা বিষয় কাজ করছে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও অনেক পরিবারে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দূর হয়নি। দরিদ্রতার কারণে তাদের অনেকেরই পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সামর্থ্য নেই। কভিডের অভিঘাতে এটি আরো অবনতিশীল। আবার অনেকের কেনার সামর্থ্য থাকলেও পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। খাদ্যের পুষ্টিমান সম্পর্কেও কারো কারো মধ্যে অসচেতনতা বিরাজমান। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো বাড়লেও বিশেষত গ্রামীণ পরিসরে স্বাস্থ্যসেবা এখনো অপ্রতুল দুর্বল। এটিও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কিছু এলাকায় খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা হুমকিতে। এতে সেসব অঞ্চলে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের লভ্যতা কমছে। সর্বোপরি সরকারি কর্মসূচিগুলোর সমন্বয়হীনতা বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতারও একটা বিরূপ প্রভাব আছে। বর্তমানে প্রচার-প্রচারণার মতো পরোক্ষ কার্যক্রমে পুষ্টি খাতের সিংহভাগ ব্যয় হচ্ছে। বিপরীতে চিকিৎসা, সরাসরি খাদ্য বিতরণ ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন, এমআইএনটি পাউডার, মিনারেল খাওয়ানোর মতো প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রমে ব্যয় হচ্ছে সামান্য! সব মিলিয়ে জনসাধারণের পুষ্টিগত উন্নয়নের গতি শ্লথ।

অপুষ্টি দূর করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৫ সাল পর্যন্ত একটি বৈশ্বিক পুষ্টি উন্নয়ন টার্গেট ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে সংগতি রেখে অপুষ্টির প্রাধান্য থাকা দেশগুলো নিজেদের পুষ্টি কার্যক্রম নীতি-পরিকল্পনা সাজিয়েছে। জনসাধারণের পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দেশ ভালোও করেছে। যেমন পেরু, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড ভিয়েতনাম। তালিকায় আরো আছে ইথিওপিয়া, গুয়াতেমালা, মালাউই, তানজানিয়া, নেপালের মতো দেশ। পুষ্টি উন্নয়নে দেশগুলোর সাফল্যের অন্যতম বিষয় হলো নিজস্ব প্রেক্ষাপট উপযোগী যথাযথ লক্ষ্যাভিমুখী কৌশল গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। প্রতিটি দেশই রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গীকার, শক্তিশালী নেতৃত্ব, প্রমাণভিত্তিক নীতি হস্তক্ষেপ, নিবিড় তদারকি, পারস্পরিক সমন্বয়, পর্যাপ্ত অর্থায়ন যথাযথ জায়গায় সেটি ব্যবহার এবং জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে পুষ্টি কার্যক্রম বেগবান করেছে। ফলে এসেছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। উল্লিখিত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কৌশল আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

বৈশ্বিক ঘোষিত টার্গেটের সঙ্গে বাংলাদেশও অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারি নীতি এজেন্ডায় স্বভাবত অপুষ্টি মোকাবেলার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। জাতীয় খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা নীতি ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে নানা কর্মসূচি। পুষ্টি কার্যক্রমের পরিধিও আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষ কার্যক্রম খুব একটা বাড়েনি। ফলে অপুষ্টির চক্র থেকে আমরা বেরোতে পারছি না। অবস্থার বদলে লক্ষ্যভিত্তিক নীতি পদক্ষেপ দরকার। যেসব দেশে অপুষ্টি অত্যন্ত বেশি, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সঙ্গে শিশুর অপুষ্টি হ্রাসে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। তার প্রমাণ ১৯৯৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত স্কুলপূর্ব খর্বকায় শিশুর অনুপাত ৬০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমেছে এবং তা- বেশির ভাগ দরিদ্র গ্রামীণ এলাকায়। নানা কারণে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন বহু বিস্তৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার বিস্তৃতি, বিশেষত স্যানিটেশন ইত্যাদি। খর্বাকৃত শিশু হ্রাসে স্যানিটেশনের গুরুত্ব অপরিসীম, সম্ভবত সব উপাদানের চেয়ে বেশি কার্যকর।

দেশের কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টিহীনতার প্রাবল্য বেশি, সেটি মোটামুটি চিহ্নিত। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে মূলত প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীই অধিক হারে অপুষ্টির শিকার। কিন্তু বিদ্যমান কার্যক্রমে তারাই থাকছে উপেক্ষিত। তাদের সরাসরি পুষ্টিসেবা দেয়ার কার্যক্রমে ব্যয় হচ্ছে কম। মোট বরাদ্দের সিংহভাগই যাচ্ছে প্রচার-প্রচারণার মতো অপ্রত্যক্ষ কার্যক্রমে। যেকোনো কার্যক্রমের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে সঠিক জায়গায় যথাযথ ব্যয়ের ওপর। বর্তমান পুষ্টি কার্যক্রমের ব্যয় ভুল টার্গেটিংয়ের সমস্যায় ভুগছে। পরোক্ষ কাজে ব্যয় হচ্ছে বেশি, আসল কাজে অর্থ প্রবাহিত হচ্ছে না। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই মানুষের পুষ্টিনিরাপত্তায় কাজ করছে। অনেক কর্মসূচিই চালু রয়েছে। তবে একটির সঙ্গে আরেকটির সমন্বয় নেই। এক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা কাজের পরিধি বাড়িয়ে এসব কাজে সমন্বয় করা যেতে পারে। পুষ্টি কার্যক্রমকে সুসমন্বিতভাবে কীভাবে লক্ষ্যাভিমুখী কৌশল গ্রহণ তার প্রকৃতদের সেবা দেয়া যায়, তার উপায় বের করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য পরিবেশ তৈরির জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন তার বাস্তবায়ন এবং অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার যেমন ডালজাতীয় শস্য, ফলমূল সবজিবিষয়ক গবেষণা উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) বিনিয়োগ, বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে পুষ্টি খাদ্যসংক্রান্ত জ্ঞান, আচরণগত পরিবর্তনে সচেতনতা, ময়লা-আবর্জনা মলমূত্র যাতে শিশুদের মুখে যেতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা। সর্বোপরি কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিবেশ খাতের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় প্রয়োজন।

বর্তমানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যেভাবে বহুমাত্রিক অপুষ্টিতে ভুগছে, তাতে একটি রূপান্তরশীল অর্থনীতির উপযোগী জনশক্তি পাওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। অপুষ্টির সঙ্গে উৎপাদনশীলতার সংযোগ প্রত্যক্ষ। অপুষ্টি দূর হলে শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা আরো বাড়বে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে গুণিতক হারে। করোনার প্রেক্ষাপট থেকে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। একটি সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্র মানুষের পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে আরো সক্রিয় হবে, এটিই প্রত্যাশা। মূলকথা, খাদ্য উৎপাদন নীতিমালা এমন হওয়া উচিত, যাতে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের অভাব না হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন