কলকাতায় খুন এমপি আনোয়ারুল আজীম

ভারতীয় পুলিশের তথ্যে দেশে তিনজন গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। একটি বাসায় পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে কলকাতা পুলিশ। তবে এখনো তার মরদেহ উদ্ধারের বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। এদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে অপহরণ করা হয়েছে দাবি করে এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। সেই সঙ্গে ভারত পুলিশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। 

হত্যারহস্য উদঘাটনে দুই দেশের পুলিশ যৌথভাবে কাজ শুরু করছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ধানমন্ডিতে গতকাল নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে স্থানীয় ইন্ধন রয়েছে কিনা সেটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।

তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অবশ্য কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়িক কারণে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী তারই ছোটবেলার এক বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার।

কালীগঞ্জ উপজেলা ও সদরের চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। ছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। চিকিৎসার জন্য গত ১১ মে তিনি দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। কলকাতায় পৌঁছে ওঠেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। কিন্তু ১৬ মে থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। আনার নিখোঁজ জানিয়ে গত শনিবার বরাহনগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গোপাল বিশ্বাস। তাতে উল্লেখ করা হয়, ১৩ মে দুপুরে গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি এমপি আনার। তবে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আসা এক বার্তায় বলা হয়, দিল্লি যাচ্ছেন তিনি। 

বেশ কয়েক দিন নিখোঁজ থাকার পর ভারত পুলিশের বরাত দিয়ে দেশটির গণমাধ্যমে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের মৃত্যুর খবর আসে। তবে খোঁজ মেলেনি মরদেহের। এমপি আনার নিখোঁজের ঘটনায় কলকাতা সংলগ্ন সিঁথি পুলিশ স্টেশনেও একটি জিডি করা হয়। সেখানকার এক শীর্ষ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, সঞ্জিভা গার্ডেনের এক ফ্ল্যাটের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে রক্তের দাগ ও অন্যান্য প্রমাণ রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ১৩ মে ওই এমপির সঙ্গে এক নারীসহ তিনজন সেখানে ঢুকেছিলেন। পরে তারা পৃথকভাবে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যান। এর মধ্যে ১৫ মে একজন, ১৬ মে আরেকজন ও ১৭ মে আরেকজন বের হন ওই ফ্ল্যাট থেকে। 

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘মূলত বুধবার সকালে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে তিনি খুন হয়েছেন। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে আনোয়ারুল আজীমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ যে তথ্য দিয়েছে, সে অনুযায়ী আমাদের পুলিশ তিন অপরাধীকে ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তদন্ত চলছে। কীভাবে এমপি আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হলো এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় যারা আটক হয়েছেন তারা সবাই বাংলাদেশী। তদন্তের স্বার্থে এর বেশি কিছু বলা যাবে না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিস্তারিত জানানো হবে। এ ঘটনায় জড়িত আরো কয়েকজনকে ধরার চেষ্টা চলছে।’ 

আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এমপি আনার হত্যার ঘটনায় ভারতের জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এ ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। হত্যার রহস্য উদঘাটনে এরই মধ্যে যৌথভাবে দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে। তদন্তের স্বার্থে ইন্ডিয়ান পুলিশ আমাদের কাছে যে ধরনের সহযোগিতা চাইছে, তা আমরা দিচ্ছি। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক যত ওয়ে (উপায়) রয়েছে, তা কাজে লাগানো হচ্ছে। আমরা তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই এখন বলব না। মরদেহ এখনো আমাদের হাতে আসেনি। আমরা যতটুকু খবর পাচ্ছি, সে অনুযায়ী তদন্ত করছি।’ 

আনোয়ারুল আজীম যে এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন, সেটি সীমান্তবর্তী ও সন্ত্রাসকবলিত এলাকা বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য যাওয়ার (কলকাতা) পর ওই ঘটনা ঘটে। আমাদের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। আমরা শিগগিরই এ খুনের মোটিভ কী ছিল তা আপনাদের জানাতে পারব। ভারতের পুলিশ আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। তদন্ত শেষ হলে সবাইকে জানানো হবে তিনি কেন খুন হয়েছেন, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন হয়েছেন।’

এদিকে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে মামলা করেছেন নিহতের বড় মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় গতকাল সন্ধ্যায় মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়। জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি মো. আহাদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম গত ৯ মে মানিক মিয়া এভিনিউর সংসদ সদস্য ভবন থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হন। সেখানে তাকে হত্যা করায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের হয়েছে।’ 

মামলার এজাহারে মেয়ে ডরিন উল্লেখ করেন, ‘কলকাতা যাওয়ার পর বাবার সঙ্গে গত ১১ মে বেলা ৪টা ৫৫ মিনিটে ভিডিও কলে কথা হয়। সে সময় তার কথাবার্তা কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলে তার ফোন বন্ধ পাই। গত ১৩ মে বাবার ইন্ডিয়ান সিম থেকে মেসেজ আসে। সেখানে লেখা ছিল—‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত সাহার কাছে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেয়ার দরকার নেই। আমি পরে ফোন দেব।’ এটা ছাড়া আরো কয়েকটি মেসেজ আসে। আর মেসেজগুলো তার ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে। আমি পরে বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজখবর করতে থাকি। কিন্তু খোঁজ না পেয়ে বাবার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে উনি ভারতের বরাহনগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে আমার বাবাকে অপহরণ করেছে।’

পশ্চিমবঙ্গের বিধাননগরের নিউটাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে পুলিশ কোনো মরদেহ খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমপি আনোয়ারুল আজীমের হত্যার ঘটনা খুবই দুঃখজনক, মর্মান্তিক, অনভিপ্রেত। যে ফ্ল্যাটে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে কলকাতা পুলিশ ধারণা করছে, সেখানে তারা ঢুকেছিল। কিন্তু মরদেহ সেখানে পায়নি। তবে হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিবি গ্রেফতার করেছে, কলকাতা পুলিশও দুজনকে গ্রেফতার করেছে। কীভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। আমরা কলকাতায় আমাদের উপ-হাইকমিশনের মাধ্যমে খোঁজ রাখছি। তারা কলকাতা পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ 

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যায় বাংলাদেশের অপরাধীরা জড়িত বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ। মিন্টো রোডের কার্যালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটি একটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি পারিবারিক, আর্থিক, নাকি এলাকার কোনো দুর্বৃত্তকে দমন করার জন্য হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি। অনেক তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে সেসব বিষয় আমরা বলতে চাচ্ছি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এটুকু বলতে চাই, কালীগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। একজন সংসদ সদস্যকে কিছু অপরাধী নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তাদের কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এটি পারিবারিক, আর্থিক, নাকি অন্য কোনো কারণে হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন