আর্থিক খাতের রহস্যময় চরিত্র মোয়াজ্জেম হোসেন

পরিচালক না প্রতারক?

জেসমিন মলি

আর্থিক খাতের এক রহস্যময় চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। পিপলস লিজিংয়ের লুণ্ঠন ঘটনায় বহুলাংশেই দায়ী করা হয় তাকে। এবার সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায়ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে তার নাম উঠে এসেছে। ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে দুদকের একাধিক মামলায় আসামি হতে যাচ্ছেন এসবিএসি ব্যাংকের পরিচালক। সাবেক চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনসহ ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তাকেও আসামি করা হচ্ছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগের একটি মামলায় পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে করা দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠানটি লুণ্ঠনের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে এসেছে। জিজ্ঞাসাবাদে উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়ার জন্য মোয়াজ্জেম হোসেন পিকে হালদারের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা ঘুস নিয়েছেন বলেও জানিয়েছিলেন। এবার সেই একই মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে এসবিএসি ব্যাংক থেকে পিপলস লিজিংয়ের কায়দায়ই অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করার প্রয়াস চালানোরও প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

আল আমিন এন্টারপ্রাইজ রাফি-মাহি এন্টারপ্রাইজ নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খুলে নিজের কর্মচারীদের নামে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। সে ঋণের অর্থ আবার জালিয়াতির মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয় নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে। বিষয়টিকে স্পষ্টতই মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে দেখছেন দুদকের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

একই কায়দায় এসবিএসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের ঋণ জালিয়াতির তথ্যও দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। খুলনা বিল্ডার্স নামে অস্তিত্বহীন একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন আমজাদ হোসেন। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তেও তথ্য উঠে এসেছে। বিএফআইইউর তদন্ত দল সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি। আবার ঋণ প্রস্তাবে বাংলামোটরের একটি গুদামের কথা বলা হয়েছিল। সে ঠিকানায়ও কোনো গুদামের অস্তিত্ব পায়নি দুদকের অনুসন্ধান দল। এসবিএসি ব্যাংকের নিজস্ব নিরীক্ষায়ও প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বহীনতার তথ্য উঠে এসেছে। নিরীক্ষায় ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য দেয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনও ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে দুদকে পাঠানো হয়েছে। ঋণ হিসেবে নেয়া ২২ কোটির মধ্যে ১৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল শনিবার ব্যাংক ছুটির দিনে। লেনদেনকেও স্বাভাবিক হিসেবে দেখছে না দুদক।

মতিঝিল শাখা থেকে এসবিএসি ব্যাংকের পরিচালক এম মোয়াজ্জেম হোসেন চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন যৌথভাবে মেসার্স আদর এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কোটি টাকার এসওডি ঋণসীমা মঞ্জুর করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রোপ্রাইটর হিসেবে দেখানো হয়েছে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান -সিকিউরিটিজের কর্মচারী জহিরুল ইসলামকে।

আমজাদ হোসেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম তাদের কর্মচারীদের নামে আল আমিন এন্টারপ্রাইজ রাফি-মাহি এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। প্রথমে প্রতিষ্ঠান দুটির নামে ট্রেডিং ব্যবসার অজুহাতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করানো হয়। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট শাখা কর্মকর্তাদের সহায়তায় সে অর্থ আমজাদ হোসেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমের ব্যক্তিগত হিসাবে এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এটিকে মানি লন্ডারিং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমজাদ হোসেন মোয়াজ্জেম হোসেন এরই মধ্যে এসবিএসি ব্যাংকের পর্ষদ সভায় মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ স্বীকার করেছেন। ছয় মাসের মধ্যে তারা ওই অর্থ ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন বলে ব্যাংকের বোর্ড রেজল্যুশনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া এসবিএসি ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি বর্তমানে দুদকের হাতে রয়েছে। এছাড়া কমিশনের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ব্যাংক থেকে -সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্রও সংগ্রহ করেছেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন এসএম আমজাদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণের নামে নেয়া প্রায় শতকোটি টাকা আত্মসাৎ মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। শিগগিরই তাদের আসামি করে একাধিক মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে। অভিযোগটির অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগটির অনুসন্ধানকাজ চলমান রয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই।

পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ওই চার কোম্পানির একটি পিপলস লিজিং। নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে এসব কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে বসা পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পরিবর্তে পুনরুজ্জীবিত করতে ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামাল-উল আলমকে পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন