৩২ বছর পর আবারো আফগান সংকটে যুক্ত হচ্ছে রাশিয়া

বণিক বার্তা ডেস্ক

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছবি: এপি

আফগানিস্তানে একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে তালেবানরা। তাদের পুনরুত্থানে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছে দক্ষিণ মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে। বিশেষ করে রাশিয়াকে এখন নিয়ে সরব হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে বেশি। মস্কোর আশঙ্কা, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা প্রতিবেশী মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া জঙ্গি সংগঠন আইএসের উত্থান, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, কানেক্টিভিটিসহ নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরো বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশাসন।

আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল রাশিয়া তথা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য পাঠানোর মধ্য দিয়ে। প্রায় এক দশক ধরে বিপর্যয়কর যুদ্ধ চালানোর পর ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে রুশ সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এরপর কূটনৈতিক তত্পরতা থাকলেও আফগান সংকটের সঙ্গে সরাসরি নিজেকে জড়ায়নি মস্কো। বিশেষ করে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর পর থেকে দেশটি নিয়ে রাশিয়াকে কথা বলতে দেখা গিয়েছে কালেভদ্রে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার তালেবানদের উত্থানের প্রেক্ষাপটে আবারো আফগানিস্তানকেন্দ্রিক ভূরাজনীতিতে তত্পর হয়ে উঠেছে মস্কো।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আফগানিস্তান নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত রাশিয়াই সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে কূটনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি তালেবান কাবুল সরকারের মধ্যে এক শান্তি আলোচনারও আয়োজন করেছিল রাশিয়া। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট পক্ষ দেশগুলোকে নিয়ে একের পর এক আলোচনায় বসেছে দেশটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া এখন বেশ মনোযোগ দিয়েই আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সেখানে ক্রমেই সুদৃঢ় হচ্ছে তালেবানদের অবস্থান। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে কুন্দুজের প্রাদেশিক রাজধানীসহ বেশকিছু এলাকা দখল করে নিয়েছে তালেবানরা। ব্যাপক লড়াই চলছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাজার--শরিফের দখল নিয়েও। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কাবুলের পক্ষে তালেবানদের বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। যদিও রুশ কূটনীতিকদের দাবি, তালেবানদের এখনো সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছে না মস্কো। কাবুলে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি ঝিরনভও সম্প্রতি এমন মন্তব্য করেছেন।

দিমিত্রি ঝিরনভের কথায় অন্য সুর থাকলেও বর্তমানে আফগানিস্তান নিয়ে ক্রমেই দুশ্চিন্তা বাড়ছে রাশিয়ার। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশ পক্ষকে নিয়ে বারবার আলোচনায় বসছে মস্কো। আজও কাতারের রাজধানী দোহায় একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনার মূল উদ্যোক্তা রাশিয়া। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আফগানিস্তান ইস্যুতে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার জায়গা হলো মধ্য এশিয়া। আফগানিস্তানে সরকারি তালেবান বাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষের আড়ালে শক্তিশালী হয়ে উঠছে জঙ্গি সংগঠন আইএস। আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা বিলম্বিত হলে আইএস নিজের অবস্থানকে আরো শক্ত করার সুযোগ পাবে বলে আশঙ্কা করছে মস্কো। সেক্ষেত্রে মধ্য এশিয়ায় জঙ্গি সংগঠনটির উৎপাত বাড়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তর ককেশাস অঞ্চলে এরই মধ্যে আইএসের সঙ্গে রুশ নিরাপত্তা বাহিনীর জোর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারলে আইএস সেখানেও শক্তি বিস্তারের সুযোগ পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অবস্থায় রাশিয়ার প্রস্তাব, কাবুলের ক্ষমতাসীন তালেবানসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। সেক্ষেত্রে আইএস সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে কাবুল নিজেই।

কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, আফগান সংকটকে মধ্য এশিয়ায় নিজের প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে দেখছে রাশিয়া। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের বিশ্লেষক স্যামুয়েল রহমানি সম্প্রতি টিআরটি ওয়ার্ল্ডে লিখেছেন, রাশিয়ার উদ্যোগে গঠিত ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের (ইএইইউ) পরিধি কাজাখস্তান কিরগিজস্তানের বাইরে সম্প্রসারণ করা যায়নি। যদিও তাজিকিস্তান উজবেকিস্তানের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পরও খুব একটা লাভ হয়নি। এছাড়া দক্ষিণ কিরগিজস্তানে রাশিয়ার দ্বিতীয় সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনাও খুব একটা এগোয়নি। তবে বর্তমানে আফগান সংকট রাশিয়ার সামনে নিজেকে মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তারক্ষক হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তাজিকিস্তান কিরগিজস্তানের রুশ সামরিক ঘাঁটিগুলোকে যেকোনো মুহূর্তে সংঘাতের জন্য আরো প্রস্তুত করে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া কিরগিজস্তানের কাছে সামরিক উপকরণ বিক্রিরও পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। প্রয়োজনের সময় মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়ার মাধ্যমে অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধির উচ্চাশাকেও ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হচ্ছে মস্কো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন