অভিমত

এত ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে বিশ্ব কী করবে?

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

মনে করেন একটি দেশে কোনো এক জানা বা অজানা কারণে ফুলের দাম (ধরুন, গোলাপ) হঠাৎ বেড়ে গেল। গোলাপের এমন আকাল যে তার দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আপনার মাথায় আচমকা একটা বুদ্ধি এল, স্রেফ মজার ছলে। আপনি কাগজের গোলাপ বানাবেন মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। করলেনও তা-ই। আপনাকে চমকে দিয়ে বাজারে কাগজের সব গোলাপ বিক্রি হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, দিনে দিনে আপনার গোলাপের দাম বাড়তেই থাকল। এরই মধ্যে কাগজের গোলাপের সরবরাহ আপনি বাড়িয়ে দিলেন অনেক গুণে। অর্থনীতির নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দাম বাড়তেই থাকল। কেন দাম বাড়ছে তা আপনার মাথায় আসছে না? কোনো অসুবিধা নেই, আপনি কাগজ দিয়ে নতুন নতুন গোলাপ বানাচ্ছেন আর দেদার তা বিক্রি হচ্ছে।

ঠিক এমনটাই হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি ডজকয়েন-এর ক্ষেত্রে। সফটওয়্যার প্রকৌশলী বিলি মার্কাস জ্যাকসন পামার যখন দেখলেন কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে তখন অনেকটা ব্যঙ্গ করার ছলেই ২০১৩ সালে মাইনিং করলেন ডজকয়েন। তাদের ব্যঙ্গাত্মক মনোভাব প্রকাশ করেছেন কয়েনের গায়ে কুকুরের মাথার ছবি দিয়ে (ইংরেজিতে যাদের বলে মিম কয়েন) ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কয়েনটির দাম শূন্যের কাছাকাছি ছিল। তার পরই কয়েনটির ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে। মে মাসে কয়েনটির দাম সর্বোচ্চ উঠে প্রায় ৭২ সেন্ট। সবার ধারণা ছিল এটি এক ডলারের সীমা ছুঁয়ে ফেলবে অচিরেই, যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। কয়েনটির বর্তমান জোগানের পরিমাণ প্রায় হাজার ৩০০ কোটি। প্রতি মিনিটে ১০ হাজার ডজকয়েন যোগ হচ্ছে বাজারে।

শুধু ডজকয়েন নয়, অন্য অনেক ক্রিপ্টোকারেন্সির গল্পটা একই। বর্তমানে বাজারে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু আছে, যার বাজারমূল্য বর্তমান বছরের এপ্রিলে ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। তবে থেমে নেই নতুন নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সির আবিষ্কার। প্রশ্ন হলো, এত ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে বিশ্ব কী করবে?

ক্রিপ্টোকারেন্সির যাত্রা শুরু ২০০৮ সালে সাতোশিনাকামোতো নামে একজন জাপানিজের হাত ধরে বিটকয়েন প্রচলনের মাধ্যমে। নাকামোতোর প্রত্যাশা ছিল কোনো রকম মধ্যস্থতাকারী ব্যতিরেকে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির কাছে (পিআর টু পিআর) অর্থের হস্তান্তর করা। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সরকারের চাপিয়ে দেয়া অনুশাসন পরিহার করে সহজে এবং স্বল্প খরচে লেনদেন সম্পন্ন করা যাবে। মোদ্দাকথা, বিটকয়েনের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত মুদ্রাকে প্রতিস্থাপন করা। কেননা সরকার যেহেতু এককভাবে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ইচ্ছে করলেই সরকার মুদ্রা ছাপিয়ে তাদের কার্যসিদ্ধি করতে পারে, ফলে মুদ্রা তার অন্তর্নিহিত মূল্য হারায়। যেহেতু বিটকয়েনের সরবরাহ সীমিত (মোট কোটি ১০ লাখ, যার মধ্যে কোটি ৮৭ লাখ এরই মধ্যে মাইনিং হয়ে গেছে) এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিকেন্দ্রীভূত, তাই প্রচলিত মুদ্রার বিকল্প হিসেবে বিটকয়েন বেশ আকর্ষণীয়।

বিটকয়েনের আদর্শকে (যদিও কোনো কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার শুধু লেনদেনের মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ) সামনে রেখে বাজারে এল সাড়ে হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি। এগুলোর সবই কি প্রচলিত মুদ্রাকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম? বিটকয়েন তার উদ্দেশ্য সাধনে কতটুকু অগ্রসর হলো? প্রশ্নের উত্তর কেবল ভবিষ্যৎই দিতে পারবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যৎ কিছুটা অনুমান করা যায়। প্রথমত, ক্রিপ্টোকারেন্সি অতীতের যেকোনো আর্থিক প্রযুক্তির চেয়ে বেশি বিষময় (টক্সিক) গত এক বছরে বিটকয়েনের মূল্য হাজার মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে সর্বোচ্চ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। ঠিক যেভাবে দাম বেড়েছে সেভাবেই আবার কমে বর্তমানে ৩৩ হাজার মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। এটাই প্রথম নয়, তার আগেও ২০১২ ২০১৬ সালে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। আর দামের উত্থান-পতনে বিটকয়েনকে (যাকে ক্রিপ্টোকারেন্সির অগ্রদূত ভাবা হয়) অনুসরণ করেছে বাজারে প্রচলিত অন্য সব ক্রিপ্টোকারেন্সি।

এই অস্থির ডিজিটাল মুদ্রা লেনেদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আদৌ গ্রহণ করবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্যতম ভক্ত হলো টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলোন মাস্ক। প্রযুক্তির অন্যতম ভক্ত বিলিয়নেয়ারের একটি টুইটে বদলে যায় অনেক কিছু। যেমন একসময়ের বিটকয়েনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইলোন মাস্ক টেসলা গাড়ি বিক্রয়ে বিটকয়েন গ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অমনি হু-হু করে বেড়ে যায় বিটকয়েনের দাম। ভদ্রলোক আবার টুইট করলেন যে পরিবেশের কথা চিন্তা করে বিটকয়েনের মাধ্যমে তিনি আর গাড়ি বিক্রি করবেন না। আবার হু-হু করে নিচে নেমে এসেছে। এই ইলোন মাস্কই আবার ডজকয়েনের ত্রাতা হয়ে এলেন। ব্যস, ডজকয়েনকে আর পায় কে। তামাশা করার অভিপ্রায়ে সৃষ্ট একটি কোম্পানির দাম আজকে প্রায় হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিংয়ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে খ্যাত চীন। সম্প্রতি দেশটির সরকার ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে এবং সেই সঙ্গে ক্রিপ্টো-মাইনিংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বর্তমান বাজার ধসের এটাই প্রধান কারণ হিসেবে ভাবা হয়। এই যখন ক্রিপ্টোকারেন্সির হাল, লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে এর সার্বজনীন ব্যবহার এখনো দিল্লি বহু দূর

ক্রিপ্টোকারেন্সির দামের এই নিত্য ওঠানামার সমস্যা সমাধানে কেউ কেউ অবশ্য অটল মুদ্রা (স্ট্যাবল কয়েন) চালু করার কথা ভাবছে। ফেসবুক প্রথম ঘোষণা দিয়েছিল তাদের নিজেদের ডিজিটাল মুদ্রা লিব্রা চালু করার। দেশে-বিদেশে একচ্ছত্র সমালোচনা ফেসবুককে পরিকল্পনা বর্জন করতে বাধ্য করেছে। এরপর ডিয়াম নামের নতুন আরেকটি মুদ্রা চালু করার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি, যা অটল মুদ্রা বলে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি ডিয়াম হবে মার্কিন ডলারের সমান। মার্কিন ডলারের দামের সঙ্গে ডিয়ামের দামের ওঠানামা করবে। যদি তাই হয়, সরকারের প্রচলিত ফিয়াট মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর কারণে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকানোর যে স্বপ্ন দেখছে ক্রিপ্টোকারেন্সি, সেটা অধরাই থেকে যাবে। অতএব, অটল মুদ্রা প্রচলিত ফিয়াট মুদ্রার বিকল্প নয়।

ইলোন মাস্কের পরিবেশবিষয়ক যুক্তিটা একটু ক্ষতিয়ে দেখা যাক। ক্যামব্রিজ সেন্টার ফর অল্টারনেটিভ ফাইন্যান্সের মতে, শুধু বিটকয়েন প্রতি বছর প্রায় ১১০ টেরাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ খরচ করে, যা পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। আরো সহজ করে বলতে গেলে, বিদ্যুতের এই ব্যবহার মালয়েশিয়া বা সুইডেনের মতো ছোট দেশগুলোর বার্ষিক ব্যবহারের সমান। বিটকয়েনের বেশির ভাগই এরই মধ্যে মাইনিং হয়ে গেছে কিন্তু অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির মাইনিং অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তদুপরি, ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে লেনদেনের বৈধতা অনুমোদন করতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন তা অনেকটাই অজানা, যেহেতু বড় আকারে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এটা অবশ্যই বিবেচনার বিষয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় পরিবেশের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, সেখানে বিদ্যুিনর্ভর ক্রিপ্টোকারেন্সি আদৌ ফিয়াট মুদ্রার টেকসই বিকল্প কিনা।

এবার আসা যাক ক্রিপ্টোকারেন্সির সরবরাহ নিয়ে। বিটকয়েনসহ হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বাকি সব ক্রিপ্টোকারেন্সির সরবরাহ কী পরিমাণ হবে তা অজানা। প্রতিনিয়তই তাদের মাইনিং চলছে এবং সরবরাহ বাড়ছে। আবার অনেকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বিকেন্দ্রিক নয়। অবস্থায় ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে প্রচলিত ফিয়াট মুদ্রাকে প্রতিস্থাপনের যুক্তি ধোপে টেকে না। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অনুমোদন দেবে কিনা, সেটা এখনো অনেকটাই ধোঁয়াশা। কারণ মার্কিন মুলুকের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে শুরু করে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে নিজেদের ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। অবস্থায় বেনামি কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সিকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে অনুমোদন দেবে কিনা, তা অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও বটে।

সত্ত্বেও বাজারে চালু আছে এমন সব ক্রিপ্টোকারেন্সির দামের উল্লম্ফন দেখা গেছে অস্বাভাবিক হারে। কেন? আসলে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। ক্রিপ্টোকারেন্সির অন্তর্নিহিত মূল্য রয়েছে অর্থনীতিতে ব্লকচেইন প্রযুক্তির নানা ব্যবহারে। তবে তাদের বাস্তব প্রয়োগ বড় মাপে এখনো অনুপস্থিত। ভবিষ্যতে ব্লকচেইনের সর্বজনীন ব্যবহারে রয়েছে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা। অবস্থায় নাম-ধাম নির্বিশেষে ক্রিপ্টোকারেন্সির দামের একচ্ছত্র উল্লম্ফন সহজে যৌক্তিক ব্যাখ্যার মধ্যে ফেলা যায় না। প্রচলিত ব্যাখ্যার আলোকে বলা যায় যে ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্য থাকার একমাত্র কারণ হলো অনেকে মনে করেন যে এগুলো ভালো বিনিয়োগের ক্ষেত্র। করোনাকালীন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উদার মুদ্রানীতি চালু রয়েছে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে। এতে সুদহারকে নামিয়ে আনা হয়েছে শূন্যের কাছাকাছি বা ঋণাত্মক পর্যায়ে। অন্যদিকে লকডাউনে মানুষের স্বাভাবিক ব্যবসা কার্যক্রম স্থগিত তথা চলাফেরা সীমিত ছিল। এসব নিয়ামক অবশ্যই অনেকের জন্য ক্রিপ্টো-মার্কেটে লেনদেন করার অবকাশ তৈরি করেছে।

তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে মহানির্বোধ বা গ্রেটার ফুল তত্ত্ব। তত্ত্বটা মোটামুটি রকম, একটি উঠতি বাজারে কোনো পণ্যের দাম যখন ক্রমাগত বাড়তে থাকে তখন আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা এক ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকেন। প্রথমত, যদি উঠতি বাজারে বিনিয়োগ করা না হয় আর বাজার অবিচলভাবে বাড়তেই থাকে তাহলে একটি লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগকে অবহেলা করা হলো। অন্যদিকে যেহেতু বাজার এক ধরনের বুদ্বুদের মধ্যে আছে, যেকোনো সময় বুদ্বুদ ফেটে যেতে পারে, তাই বাজারে বিনিয়োগ করা অতি ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বন্দ্বের মধ্যে বেশির ভাগ সময়ে জিতে যায় লাভজনক বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়। তাই বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চিত বাজারেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। তাদের ধারণা, আমি যদি বর্তমানে বিনিয়োগ করে নির্বোধ বনে যাই, তবে ভবিষ্যতে আমিও এমন একজন মহানির্বোধ-এর সাক্ষাৎ পাব, যার কাছে আমি আরো বেশি দামে বিক্রি করতে পারব। প্রবণতা চলতে থাকে যতক্ষণ না বুদ্বুদ কাটিয়ে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ক্রিপ্টো-মার্কেটে মহানির্বোধের উপস্থিতির সময় কি হয়ে এল?

 

. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান

ফাইন্যান্স অর্থনীতি বিভাগ, নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন