আলোকপাত

চাকরি-পরবর্তী উদ্যোক্তা হওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা

শওকত হোসেন

কবি সুফিয়া কামালের কবিতা ঈষৎ পরিবর্তন করে বলা যায়, আমাদের যুগে আমরা যখন ঘুরেছি জবের জন্য/ তোমরা যুগে সেই বয়সেই উদ্যোক্তা হতে হন্য।

অনেক ছাত্র এখন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপন দেখে। মা-বাবারাও উৎসাহ দেন। অথবা মেনে নেন। ১০ বা ১৫ বছর আগে কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল না। যদিও উদ্যোক্তা জীবনের সংগ্রাম একটুুও কমেনি। বন্ধুর পথ মসৃণ হয়নি। বরং করোনা অনেক উদ্যোক্তার জীবনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। কারণ নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সেফটি নেট বলে কিছু নেই। তাদেরও সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স বলে কিছু থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহায়-সম্বল যা আছে তা- নিয়ে শুরু করেন। তাই কোনো অঘটন ঘটলে আর উঠে দাঁড়াতে পারেন না।

উদ্যোক্তা হওয়ার আগে কি কিছুদিন চাকরি করা উচিত? ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। তবে কোনোটাই সর্বাঙ্গীণভাবে ভালো বা খারাপ নয়। দুটোতেই কিছু সুবিধা কিছু অসুবিধা আছে। দেখে নেয়া যাক কিছুদিন চাকরি করে উদ্যোগ শুরু করার সুবিধা-অসুবিধাগুলো।

সুবিধাগুলো

নিয়ম-নীতি শেখা: উদ্যোক্তা হওয়ার আগে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার বড় সুবিধা হলো, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান কিছু নিয়ম-নীতি দিয়ে গড়ে ওঠে। প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠান মানে ইট-কাঠের ঘর-দুয়ার বা কিছু মানুষের সমাহার নয়। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান, নিয়ম-নীতি (যেমন আর্থিক নীতি বা মানবসম্পদ নীতিমালা) সাংগঠনিক কাঠামো ইত্যাদি। একজন কর্মী সেসব নীতি দেখার এবং তার উপকার বা অপকার উপলব্ধি করার সুযোগ পান। কোনো নীতিই সম্পূর্ণ নির্ভুল বা ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই তিনি চাকরীকৃত প্রতিষ্ঠানের আলোকে নিজের প্রতিষ্ঠানের নীতি তৈরি করতে পারেন।

শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন: একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়, যেমন অফিসে উপস্থিতির সময়, কাজ শেষের সময়, তত্ত্বাবধায়কের আদেশ-নির্দেশ মান্য করা, পোশাক-আশাকে শালীনতা বজায় রাখা ইত্যাদি। শৃঙ্খলা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদা। তবে যে প্রতিষ্ঠানের যে নিয়ম, তা মেনে চলাই দস্তুর। যেমন ব্যাংক বা এনবিএফআইয়ে খুব ফরমাল পোশাক-আশাক (ছেলেদের ক্ষেত্রে স্যুট, টাই, ফরমাল শার্ট ইত্যাদি) পরা নিয়ম। আবার গ্রাহকসেবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেবার মান নির্ধারণ করে দেয়। এসব নিয়ম-শৃঙ্খলা একজন উদ্যোক্তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে শেখায়। উপদেশ বা আদেশ-নির্দেশ দিয়ে কোনো কিছু করানোর চেয়ে আপনি আচরি শেখানো সহজ।

পারস্পরিক যোগাযোগ: অফিসে ঊর্ধ্বতন, অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। কাজ করতে গেলে মনোমালিন্য হয়। নিজেদেরই সেটা সমাধান করে এগিয়ে যেতে হয়। অফিস পলিটিকস হয়, কাজের প্রেসার, টার্গেটের প্রেসার থাকেএসব উতরিয়ে কাজ করতে হয় অফিসে। অধস্তনদের প্রণোদনা দিয়ে কাজ আদায় করতে হয়। অন্য ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে খাতির রাখতে হয় কাজের স্বার্থে। এসব জ্ঞান কোনো বই-পুস্তকে মেলে না, স্কুলে পড়ায় না। অভিজ্ঞতার আলোকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়। উদ্যোক্তা, নিজের অফিসের বড় কর্তা। অনেক ক্ষেত্রে অন্য কর্মীদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতে পারেন না। দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। তাছাড়া মালিক হিসেবে তার সঙ্গে তর্ক করার কেউ নেই। সুতরাং অনেক ক্ষেত্রে তার ভুল সিদ্ধান্ত কেউ ধরিয়ে দেন না। আমাদের সংস্কৃতিতে তা আরো কঠিন। তাই অন্য অফিসে চাকরি করে তিনি ব্যক্তি যোগাযোগে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।

জনসম্পদ ব্যবস্থাপনা: অধিকাংশ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার হাতে জনসম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে কাজের জন্য আলাদাভাবে কাউকে নিয়োগ দেয়া যায় না, ব্যয় সংকুলানের জন্য। সংস্থা বড় হলে ধীরে ধীরে জনসম্পদ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হয়। আরো বড় হলে আলাদা বিভাগও খোলার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তবুও জনসম্পদবিষয়ক শেষ বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত উদ্যোক্তা বা মালিকের হাতেই থাকে। কেউ কোনো সংস্থায় চাকরি করলে নিদেনপক্ষে কর্মী হিসেবে জনসম্পদবিষয়ক নীতি, বিধিবিধান ইত্যাদি জানার সুযোগ হয়।

দক্ষতা অর্জন: কাজ করতে করতে হাত পাকাতে হয়। কাজ করতে গেলে ভুল হয়। সেই ভুল শুধরাতে হয়। ইতিবাচক-নেতিবাচক ব্যাপারগুলো দেখার, বোঝার সুযোগ হয়। উদ্যোক্তা অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদে অন্যের খরচে ভুল করে, ঠেকে কাজ শিখে নিতে পারেন। নতুবা নিজের প্রতিষ্ঠানে ভুল করে করে তাকে শিখতে হবে। এতে শুধু ব্যয় নয়, সময়ও নষ্ট হয় বা হতে পারে।

বাজার যাচাই: যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে বাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। পণ্য যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, কাঙ্ক্ষিত দামে পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকলে সে ব্যবসা সফল হবে না। কোনো উদ্যোক্তা যদি একই ধরনের বা সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কিছুদিন চাকরি করেন, তাহলে বাজার সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন। ফিলিপ কর্টলারের বিপণন মিশ্রণের পি অনুসারে, পণ্য, দাম, প্রচার, স্থান, মানুষ, পদ্ধতি বাস্তবিক প্রমাণএর কোনো একটি উপাদান দুর্বল বা জুতসই না হলে উদ্যোক্তার পক্ষে বাজারে প্রবেশ, প্রসার বা টিকে থাকা দুরূহ হতে পারে। বিপণনের এসব প্রাথমিক জ্ঞান চাকরিকালে অর্জন করে নিলে উদ্যোক্তাজীবন অনেক ঝামেলামুক্ত হবে।

নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা: জোরদার নেটওয়ার্ক ব্যবসায় অনেক সহায়ক। উদ্যোক্তাকে ক্রেতা বা সম্ভাব্য ক্রেতা ছাড়াও জোগানদার, দক্ষ জনশক্তি, অর্থায়নকারী, সরকারি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বা বজায় রাখতে হয়। নতুন করে এদের সবার সঙ্গে সম্পর্ক করতে হলে অনেক সময় লাগতে পারে। একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তী সময়ে উদ্যোক্তা অনেক সহজেই কাজ শুরু করতে বা চালিয়ে যেতে পারবেন।

অসুবিধাগুলো

কমফোর্ট জোনে প্রবেশ: চাকরি করা সূত্রে মাস শেষে বেতন পাওয়া যায়। উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিয়োগ করতে হয়। অনেক উদ্যোক্তা সেই পর্যায়ে কোনো বেতন নেন না বা খুব অল্প পরিমাণ টাকা নেন। ব্যবসা পরিপূর্ণভাবে শুরু হলে বিক্রয় থেকে টাকা আসবে, যা থেকে খরচ মিটিয়ে পরবর্তী সাইকেলের জন্য টাকা রেখে নিজে কিছু হাতখরচ নিতে পারেন উদ্যোক্তা। সংসার বা জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হলে অনেক উদ্যোক্তার জন্য কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। বেশিদিন উৎসাহ ধরে রাখতে পারেন না। মাস শেষে বেতন পাওয়ার নিশ্চিন্ত জীবন তাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। ভাবেন, ভুল করেছি কিনা?  

পারিবারিক প্রত্যাশা তৈরি হওয়া: অনেক প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের গাড়ি দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে বাড়ি করার বা গাড়ি কেনার ঋণ পাওয়া যায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বছরে দুটি উৎসব বোনাস দেয়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান দক্ষতা বোনাস দেয়, যা বিরাট একটা অংকের টাকা। অনেক প্রতিষ্ঠানে লিভ ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স বা ছুটি উপভোগ করার জন্য ভাতা পাওয়া যায়। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে দেশ বা বিদেশে বেড়াতে বেরোন। নিজে উদ্যোক্তা হলে এসব বিলাসিতা পোষায় না। পরিবার তখন আশাহত হয়। দু-এক বছর হয়তো ধৈর্য ধরে। তারপর হয়তো মুখ ফুটে বলেই ফেলে, নিজের ব্যবসা করে লাভ কী হলো, আগের চেয়ে তো অবস্থা এখন খারাপ!

সামাজিক অবস্থান: চাকরি আমাদের দেশে শুধু আর্থিক নিরাপত্তা নয়, স্ট্যাটাস সিম্বলও বটে। পরিচয় এর প্রধান উপাদান। আপনি কী করেন? অমুক প্রতিষ্ঠানের অমুক পদে আছি। ছেলেমেয়েরা পরিচয় দেয়আমার বাবা অমুক ব্যাংকের বা তমুক মাল্টিন্যাশনালের ম্যানেজার। উদ্যোক্তার নিজের নতুন ব্যবসার অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নাম শুনে সবাই ভুরু কুঁচকে তাকায়। অনেকে স্ত্রীকে মুখের ওপর বলে দেন, আপনার স্বামীর কি চাকরি চলে গেছে? অনেক উদ্যোক্তা চাকরি শুরু করার পর স্ট্যাটাস বা আইডেন্টিটি ট্র্যাপে পড়ে যান। আর বেরোতে পারেন না।

লাইফ স্টাইল: চাকরির মাসকাবারি বেতন একটা নির্দিষ্ট জীবনমান গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ব্যবসা করতে গেলে কোনো মাসে টাকা উপার্জন না হলে সেই লাইফ স্টাইল বজায় রাখা কষ্টকর। যেমন আগের মতো গাড়ির খরচ বহন করা, ড্রাইভার পোষা, ছেলেমেয়েদের ইংলিশ স্কুলের বেতন দেয়া ইত্যাদি।

ইগো তৈরি হওয়া: আমি এক ব্যাংকে চাকরি করার সময় আমাদের এক সহকর্মী কোনো একদিন রিকশায় করে অফিসে এসেছিলেন। ওই সহকর্মী একটা বিভাগের প্রধান ছিলেন। তার মানে বেশ উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা। প্রধান নির্বাহী তাকে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ১৮-১৯ জন সিনিয়র, জুনিয়র সহকর্মীর সামনে খুব বকাঝকা করলেন ব্যাংকের সম্মানহানির জন্য। রকম জীবনধারা ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হয়। একজন উদ্যোক্তার জন্য এগুলো বদভ্যাস। প্রয়াত আনিসুল হক এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তার প্রথম উদ্যোগ টাঙ্গাইল থেকে পাট কিনে চট্টগ্রামে সরবরাহ করার সময় তিনি ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসে ভ্রমণ করেছিলেন। অনেক উদ্যোক্তা প্রথম জীবনে কায়িক পরিশ্রম করেছেন। চাকরি একটা ভ্রান্ত ইগো তৈরি করে। ইগো তৈরি হওয়ার আগেই চাকরি থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

সরাসরি উদ্যোক্তা, না কিছুদিন চাকরি করে উদ্যোক্তা হওয়া ভালো, তার কোনো সোজাসাপ্টা জবাব নেই। অনেক উদ্যোক্তাই সরাসরি নেমে পড়েছেন আবার অনেকে কিছুদিন চাকরি করে নেমেছেন। তবে চাকরি করলেও বেশিদিন করা উচিত নয়। তাতে পরিবারের প্রত্যাশা বেড়ে যায়, নিজের ইগো বাড়ে, লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আসে, কমফোর্ট জোনে ঢুকে যাওয়ার ভয় থাকে।

 

শওকত হোসেন: অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ; ম্যানেজিং পার্টনার, ভেলোসিটি এশিয়া; পরিচালক, লাইট ক্যাসল পার্টনার্স

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন