প্রকৃত বিশ্ব অর্থনীতি

৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন ও চ্যালেঞ্জ

কৌশিক বসু

জন্ম থেকেই একটি দেশকে চেনাটা সত্যিই এক অদ্ভুত ব্যাপার এবং অন্য রকম আনন্দের। জন্মটা সহজ-স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয়েছিল। ওই বছরের বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশ (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও বৈরী ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। মার্কিন মদদের ওপর ভর করে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ চালিয়েছিল নজিরবিহীন গণহত্যা। ফলে লাখো বাংলাদেশী শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তখন দিল্লিতে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গে উড়িষ্যায় (ওড়িশা) গড়ে তোলা হয়েছিল শরণার্থী  শিবির। সেখানে কাজ করতে একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমিও যোগ দিয়েছিলাম।

পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় বিমানযুদ্ধ শুরু হয় ডিসেম্বর। কারফিউ চলাকালে রাতের বেলায় কলেজে ফিরতে কলকাতায় ট্রেন ধরার কথা স্পষ্টভাবে এখনো মনে পড়ে, যখন কম্পার্টমেন্টের সব লাইট অফ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।  

এটি ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়ও। তিনি শরণার্থীদের জন্য ভারতের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ এর আগে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, তবে এটি কার্যকরভাবে স্বাধীন হয়েছিল ডিসেম্বরে।

বলে রাখা ভালো, স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ভারতের চেয়েও দরিদ্র ছিল এবং আরো বেশি দরিদ্র  ছিল পাকিস্তানের চেয়ে। বাস্তবতায় তত্কালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার কর্তৃক বাংলাদেশকে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দেয়া হয়েছিল। জন্ম-পরবর্তী বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ যেন দারিদ্র্য বঞ্চনার এক বিশাল দ্বীপ। তবে ১৯৭৪ সালে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছিল, যখন দুর্ভিক্ষ চলাকালে বাংলাদেশকে নিক্সন প্রশাসন হঠাৎ করে খাদ্যসহায়তা বন্ধ করে দেয়। এটি করা হয়েছিল যুুক্তিতে যে কিউবায় পাটের ব্যাগ রফতানি করে দেশটি কিছু অর্থ উপার্জন করছে।

আজকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে। এরই মধ্যে দেশটি বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ঘটনা সমীক্ষায় (কেস স্টাডি) পরিণত হয়েছে, যা খুব কম অর্থনীতিবিদই অনুমান করেছিলেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখন অনেকেই এটিকে একটি আকস্মিক সাফল্য হিসেবে খারিজ করেছিলেন। কিন্তু তখন থেকে প্রতি বছরই পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ এবং আশ্চর্যজনকভাবে দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি।

বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি এখন ভারতের কাছাকাছি এবং তাত্পর্যপূর্ণভাবে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটির গড় আয়ু এখন ৭৪; ভারত (৭০) এবং পাকিস্তানের (৬৮) চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ তৈরি পোশাক রফতানিকারকের একটি এবং দেশটিতে অন্য খাতগুলোও এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বেশ সম্ভাবনাময়। শিল্পের ৩০০ কোম্পানি (এর মধ্যে কয়েকটি গবেষণাও পরিচালনা করে) এখন ৯৭ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে এবং বৈশ্বিকভাবে রফতানিও শুরু করছে।

সত্য হলো, বাংলাদেশে দারিদ্র্য, আর্থিক অসচ্ছলতা, ঊর্ধ্বমুখী অসমতা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা এখনো যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত তাত্পর্যপূর্ণ বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আবারো ফিরে আসতে পারে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত করতে পারে। এসব ঝুঁকি-শঙ্কা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক রূপান্তর (বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে দেশটি এখন নিম্নমধ্যম আয়ের অর্থনীতি) অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে এবং আজকের নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে।

বলা চলে, বাংলাদেশের উত্থান ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপ আকস্মিক সুযোগেরই গল্প। দেশটির সাফল্যের বড় অংশের পেছনে ফজলে হাসান আবেদের ব্র্যাক এবং মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের মতো এনজিগুলোর অবদান রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে একটি হস্তক্ষেপ প্রত্যাশার চেয়ে বড় অবদান রেখেছিল। আর তা হলো, পরিবারের জ্যেষ্ঠ নারী সদস্যদের কাছে ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথমদিককার সিদ্ধান্ত। আমি সবখানেই বলেছি, এটি ঘরে নারীদের কথা বলার অধিকার সংহত করেছিল, পালাক্রমে শিশুকল্যাণে পারিবারিক ব্যয় প্রবাহিত করায় ভূমিকা রেখেছিল। এটি অন্যতম প্রধান কারণ গড় আয়ু, সাক্ষরতা অপুষ্টি মোকাবেলায় বাংলাদেশ কেন এত উন্নতি করেছে।

বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম বড় ক্ষুদ্রঋণ খাত আছে, যা ঋণ ফাঁদ থেকে পরিবারগুলোকে বেরিয়ে আনতে এবং নিজস্ব ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করেছে। একটি কম্পিউটেবল জেনারেল ইকুলিব্রিয়াম মডেল ব্যবহার করে সেলিম রায়হান, এস.আর. ওসমানী এবং বাকী খলিলী দেখিয়েছেন ক্ষুদ্রঋণ নিছকই অর্থগ্রহণের চেয়ে বেশি মাত্রায় পরিবারগুলোকে সাহায্য করেছে। আর্থিক-রাজস্ব মুদ্রানীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়ে এটি (পড়ুন ক্ষুদ্রঋণ) দেশটির জিডিপি -১২ শতাংশ চাঙ্গা করেছে। তবে ভাগ্যগুণেও বাংলাদেশের অনেকটা সাফল্য এসেছে। ভারত উপমহাদেশে জটিল শ্রম আইন বিদ্যমান। বিশেষ করে শিল্প বিরোধ আইনের কথা বলা যায়, যা ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতার আগে থেকেই বহাল ছিল এবং ব্যয়স্বল্পতা (ইকোনমিজ অব স্কেল) কাজে লাগাতে সমর্থ বিপুল শিল্প-কারখানার উত্থান ব্যাহত করেছিল। পাকিস্তান ১৯৫৮ সালে আইনটি সংশোধন করেছিল, কিন্তু তা করা হয়েছিল ভুল কারণে। মূলত কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে বড় করপোরেশনগুলোকে সাহায্য করার জন্য। উপরন্তু, এটি এমন অদক্ষভাবে করা হয়েছে, যা শ্রম শোষণ স্বজনতোষী পুঁজিবাদে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

অন্যদিকে একসময় পাকিস্তানের অংশ থাকলেও বাংলাদেশ অবশ্য আইনটির উত্তরাধিকার ছাড়াই জন্মলাভ করেছিল। তবে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশও তার নিজস্ব শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন করে, যা বেশ নমনীয় ছিল এবং তাতে করপোরেশনগুলোকে অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়নি। প্রধানত এটিই বাংলাদেশকে একটি সফল বৈশ্বিক ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

চূড়ান্তভাবে, একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য জোরদারে সাহায্য করেছে। সেটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনেক সময় সমালোচিত হয়েছেন, তবে দেশটির ঊর্ধ্বমুখী বাঁকবদলে তিনি একটি আবশ্যকীয় অবদান রেখেছেন। যদিও বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়, মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক এটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিখ্যাত বাংলাদেশী ভাষ্যকার আবুল বারকাত পূর্ব বাংলায় উদারবাদী মানবতাবাদী উেসর ইসলাম হিসেবে যাকে অ্যাখ্যায়িত করেছেন, ধর্মীয় মৌলবাদীরা সেটিকে অস্বীকার করেছে। শেখ হাসিনামনেপ্রাণে যিনি পুরোদস্তুর সেকুলারএসব ধ্বংসাত্মক শক্তিকে অবশ্য দমিয়ে রেখেছেন।

অনেক দেশ ধর্মীয় মৌলবাদে নিমজ্জিত হয়েছে। ফলে তাদের অর্থনীতিগুলো ধ্বংসাত্মক পরিণামের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই বিপদ প্রতিরোধের জন্য এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে। এখন ৫০ বছরের ট্র্যাক রেকর্ডের দেশটির কর্মচঞ্চল অর্থনীতি সফলতারই সাক্ষ্য। এটা অস্বীকার করার জো নেই।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন