নেপালের চলমান সংকটে সতর্ক চীন ও ভারত

বণিক বার্তা ডেস্ক

নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারির দপ্তরে গতকালই একটি শোকজ নোটিস পাঠিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। নোটিসে দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্টের কাছে নেপালি পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত বাতিলের নির্দেশনা কেন জারি করবেন না, সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে জবাব দিতে হবে জানিয়ে নেপালি সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, নিয়ে পরে আর সময় বাড়ানো হবে না।

প্রধান বিচারপতি চোলেন্দ্র সিং রানার নেতৃত্বে গঠিত নেপালি সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে বর্তমানে বিদ্যা দেবী ভান্ডারির ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৩টি রিট আবেদনের শুনানি চলছে। নেপালের সর্বোচ্চ আদালতে গতকাল যখন বিষয়টি নিয়ে শুনানি চলছিল, একই সময়ে কাঠমান্ডুর মৈতিঘর মণ্ডল এলাকায় একই বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ করছিল ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির একাংশ। মূলত পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড মাধব কুমার নেপালের নেতৃত্বাধীন ওই অংশের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সংঘাতই হিমালয়কন্যা নেপালকে ঠেলে দিয়েছে চলমান সাংবিধানিক সংকটের দিকে।

ক্ষমতাসীন দলে প্রচণ্ড-নেপালের সঙ্গে সংঘাতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন কেপি শর্মা অলি। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার কারণ হিসেবেও কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথাই উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তবে নেপালি সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দল বা অংশের যদি সরকার গঠনের মতো পার্লামেন্টে যথেষ্ট পরিমাণ আসন হাতে থাকে, সেক্ষেত্রে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু নেপালের প্রধানমন্ত্রীর নিজেরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয়ার এখতিয়ার শুধু প্রেসিডেন্টের। কারণে নিজের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারিকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানান অলি। প্রেসিডেন্ট ভান্ডারি তাতে সাড়াও দেন। প্রতিক্রিয়ায় দলপ্রধানের পদ থেকে এরই মধ্যে অলিকে উত্খাত করেছে প্রচণ্ড অংশ। দলে প্রচণ্ডের সঙ্গে যৌথ চেয়ার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন মাধব কুমার নেপাল।

কেপি শর্মা অলি পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ডের মধ্যকার বিরোধের সূত্রপাত মূলত ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে নেপালের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করেছিল কোয়ালিশনের মধ্য দিয়ে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নেপালের নির্বাচনে দেশটির কোনো রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সে সময় কেপি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) এবং পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ডের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওয়িস্ট সেন্টার) জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করে। এর সঙ্গে যোগ দেয় ছোট ছোট আরো কয়েকটি দল। সব মিলিয়ে নেপালি পার্লামেন্টের ২৭৫টি আসনের মধ্যে ১৭৫টি বা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের দখল যায় জোটের হাতে। ওই বছরেই দলগুলো একীভূত হয়ে গঠন করে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) যৌথভাবে নতুন দলের চেয়ারের দায়িত্ব নেন অলি প্রচণ্ড।

ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে গোপন এক ধরনের চুক্তির ভিত্তিতে ওই সময় অলি প্রচণ্ডের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী, মেয়াদের অর্ধেক সময় পার করার পর প্রচণ্ডের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা ছিল অলির। কিন্তু পরে চুক্তির বিষয়বস্তু ফাঁস হয়ে যায়। অবস্থায় প্রচণ্ডকে নতুন প্রস্তাব দেন অলি। ওই প্রস্তাবের ভাষ্যমতে, মেয়াদের শেষ পর্যন্ত অলিই ক্ষমতাসীন থাকবেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দেবেন। তবে একপর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, দলপ্রধানের পদ ছাড়তেও রাজি নন অলি। বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ডের সঙ্গে তার বিরোধ ঘনিয়ে ওঠে, যা শেষ পর্যন্ত ঘনীভূত হতে হতে রূপ নেয় সাংবিধানিক এক সংকটে।

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ তিনটি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন সাংবিধানিক সংকটে পড়ল নেপাল। জুনে ওই মানচিত্র প্রকাশের পর দুই দেশের সীমান্তে কিছুটা গোলযোগও দেখা দিয়েছিল। ওই সময় নেপালের পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল ভারত।

টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, ওই ঘটনার পর ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রথম ফোনালাপ হয় অলির। এর দুই দিনের মাথায় বাণিজ্যসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের ডিজিটাল ভিডিও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা -এর প্রধান সামান্ত গোয়েল একদিনের সফরে নেপালে আসেন। ওই সময় অলি প্রচণ্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন -প্রধান। নভেম্বরে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভানে নেপাল সফরে এসে অলির সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়। একই মাসে কাঠমান্ডু সফর করে যান ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। চলতি মাসেও ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ফরেন সেলের প্রধান বিজয় চৌথাইওয়ালে নেপাল সফর করে গিয়েছেন।

নেপালের চলমান রাজনৈতিক গোলযোগ নিয়ে দিল্লির বক্তব্য হলো, বিষয়টি একান্তই দেশটির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ। প্রতিবেশী শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নেপাল নেপালি জনগণের শান্তি, সমৃদ্ধি উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রায় সহায়তা অব্যাহত রাখবে ভারত।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বিষয়ে দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি আমাদের নজরে এসেছে। এসব ঘটনা নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং দেশটি নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

নেপালের চলমান সংকট নিয়ে দিল্লি সতর্ক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে চীন। প্রকৃতপক্ষে মে মাসে নেপালি ক্ষমতাসীন দলে ভাঙনের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর থেকেই বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রত্যক্ষভাবেই ভূমিকা রাখতে থাকে বেইজিং। মে জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট ভান্ডারি, অলি, প্রচণ্ড এনসিপির অন্য  নেতাদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে গিয়েছেন কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়াংকি।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর দাবি, পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাইছে চীন। চলমান সংকটের মুহূর্তেও চীনা রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়াংকি বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন বলে নেপালি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারির সঙ্গে দেখা করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত। যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, দুজনের মধ্যে মূলত কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন-সংক্রান্ত সহযোগিতা বিষয়ে আলাপ হয়েছে।

বিদ্যা দেবী ভান্ডারির পর এরই মধ্যে প্রচণ্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি মাধব কুমার নেপালের সঙ্গেও দেখা করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবার তিনি এনসিপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী বর্ষা মান পুনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন