বাংলার বীজ: রূপ, রূপান্তর ও রাজনীতি

পাভেল পার্থ

শস্য ফসলের বীজকে গ্রামবাংলার মানুষ কীভাবে দেখে? বিশেষ করে নারী কৃষকরা। তারা বলে, বীজ হলো বংশ রক্ষার হাতিয়ার। বীজ মানে পরিচয়, বীজ মানে সম্ভাবনা, বীজ মানে সমৃদ্ধি। কিন্তু গ্রামবাংলার নারীদের বীজচিন্তা কেউ কি আমলে নিয়েছে? রাষ্ট্র তা কানেও তোলেনি। গ্রামের শিশি-বোতল-ডুলি-ধামা-কলস-রাও-হাঁড়ি সব শূন্য করে বীজসম্পদ বন্দি হলো বহুজাতিক কোম্পানির জিম্মায়। মাত্র ষাট বছরে। হাজারো নামের ধানকী শস্যের বৈভবএক এক করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। বিল থেকে বাদাবনের গ্রামে ঢুকে পড়ল হাইব্রিডের মতো সংহারী বীজ। এসব বীজ চাষ করে দিন দিন কৃষকের সঙ্গে কোম্পানির সংঘর্ষ তৈরি হলো। ভূগোলের মাপে দেশটা ছোট, কিন্তু বৈচিত্র্য আর বৈভবে অনন্য। ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল, ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চল, ২৩০টি নদ-নদী, দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, ৫০ জাতিসত্তা, চামচ ঠুঁটো বাটান পাখি আর ইরাবতী ডলফিনের বৃহৎ বিচরণভূমি, নকশিকাঁথা, জামদানি আর হাজারো ধানের জাত। বাংলাদেশ বেগুনের আদি জন্মভূমি, গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর। পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামবাংলার কৃষক-জুমিয়া নারীর বছরের একটা বড় সময় গেছে বীজ রক্ষার কাজে। বীজ বাছাই থেকে শুরু করে রোদে শুকানো, সংরক্ষণ, দেখভাল, বিনিময় এমনতর নানা কাজের ভেতর দিয়ে বীজ ব্যবস্থাপনার মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল গ্রামীণ নারীর। আজ পঞ্চাশ বছর বাদে গ্রামীণ নারীর হাতে সচল হয়েছে করপোরেট গার্মেন্টস কারখানা আর নিদারুণভাবে বীজসম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার, কারগিল, ডুপন্টের মতো কোম্পানি। খাদ্যনিরাপত্তার মূল কারিগর কৃষি। আর কৃষির ভিত্তি হলো বীজ। আজ দেশে মানুষ না খেয়ে নেই সত্যি, কিন্তু কৃষির নিয়ন্ত্রণ আজ মানুষের নাগালে নেই। চারধারে বাণিজ্যিকীকরণ আর বিরাষ্ট্রীয়করণের বাহাদুরি। ফলছে ফসল, থালায় আসছে খাবার। কিন্তু কৃষির চেহারাটি এক বিশৃঙ্খল চুরমার দৃশ্যমাত্র। এর পেছনে চাপা পড়ে আছে গ্রামের পর গ্রাম বীজ হারানোর এক নির্দয় আখ্যান। আছে বীজশূন্য গ্রামীণ ভাঁড়ারের পঞ্চাশ বছরের আহাজারি। জলবায়ু বিপর্যস্ত সময়ে প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবছে দুনিয়া। করোনার নিদানে কৃষিসহ প্রাকৃতিক উৎপাদন মানুষকে নয়া বার্তা জানাচ্ছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে তাই আমাদেরও বাংলাদেশের বীজসম্পদ নিয়ে নতুন করেই ভাবতে হবে। বীজ-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় নীতি অঙ্গীকার সুনির্দিষ্ট করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে বীজবৈচিত্র্যসহ দেশের সব প্রাণসম্পদের মালিক জনগণ। বীজ তো জীবন্ত এক প্রাণসত্তা, কৃষিচর্চার মাধ্যমে বংশপরম্পরায় টিকে থাকে। এই বীজ তো কৃষকের ঘরে থাকার কথা, বহুজাতিক কোম্পানির প্যাকেটে আর ডিলারের দোকানে বিক্রি হওয়ার কথা না। বীজের রূপ আর রূপের রূপান্তর তো কৃষিচর্চার ভেতর দিয়ে বিকশিত হওয়ার কথা। কোনো কোম্পানির গবেষণাগারে জোর করে এর জেনেটিক অদলবদল তো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাই তো ঘটে চলেছে। গত পঞ্চাশ বছরে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের বীজপ্রশ্নটিকে সুস্পষ্ট করিনি। গ্রামবাংলার নারীদের বীজ-সুরক্ষার সংগ্রামকে সম্মান করিনি, স্বীকৃতি দেয়ার মতো সাহস করিনি। বাংলাদেশের বীজবৈচিত্র্যের রূপ, রূপান্তর রাজনীতি নিয়েই চলতি আলাপের বিস্তার। মূলত কৃষিজ শস্যফসলের বীজ নিয়ে গত পঞ্চাশ বছরে যে রাজনৈতিক-অর্থনীতির রূপান্তর ঘটে চলেছে সেই প্রসঙ্গটিই এখানে টানা হয়েছে।

সবুজ বিপ্লব বাহাদুরি

নানাজনের নানা পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে নানা তর্ক হয়। কিন্তু কয়েকজনের নোবেল শান্তি পুরস্কার তর্কের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিম্নবর্গের নানা আহাজারি। নরম্যান বোরলগ অন্যতম। নরম্যান বোরলগ খর্বাকৃতির জাত উদ্ভাবন করেছিলেন। যাকে পুঁজি করে দুনিয়ার শস্যফসলের বৈচিত্র্যসম্ভার দখল নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক রাজনীতি শুরু হয়। অধিক উৎপাদনের বিজ্ঞাপনকে সামনে রেখে বীজ দখলের সেই বাহাদুরির নাম দেয়া হয় সবুজ বিপ্লব মাটির তলার জল টেনে তুলে, বিষ আর সংহারী বীজ বাণিজ্যকে চাঙ্গা রাখতে খাদ্যনিরাপত্তার লোকদেখানো ছল তৈরি করে রাষ্ট্র। সবুজ বিপ্লবের যন্ত্রণায় আজ কাতর দেশের কৃষিজমি, জলাভূমি, গ্রামীণ জনপদ। বইয়াখাওরি, লালটেপা, কটকতারা, হিজলদীঘা, খবরক, খাসখানি, গ্যাল্লং, নোনাখচি, ঘুনশি, পাখবিরণ, মি.মিদ্দিম, পিঁপড়ার চোখ, সকালমুখী, কালাসোনা, চামাড়া, বালাম, জামাইনাড়ু, দাদখানি, অগ্নিশাইল, দুলাভোগ, খইয়ামটর ধানগুলো গ্রাম থেকে গ্রাম উধাও হতে শুরু করল। উচ্চফলনশীলের নামে আর নাম নয়, ধানের কপালে জুটল কতগুলো নাম্বার। যেন জেলখানার কয়েদি। জমিন থেকে বীজ বন্দি হলো বহুজাতিক কোম্পানির জিম্মায়। কৃষি বাণিজ্যে মুনাফা অবাধে লুটতে লাগল কোম্পানিগুলো, কৃষক হয়ে গেল কৃষিবাণিজ্য বাজারের এক নাম-পরিচয়হীন শ্রমমজুর।

লুণ্ঠিত বৈচিত্র্য, আক্রান্ত প্রতিবেশ

দেশে ভিন্ন ভিন্ন ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলে এখনো কিছু আদি দেশী ধানের চাষ হলেও ধান বিজ্ঞানী . হেক্টর দেখিয়েছেন একটা সময় দেশে প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি ধানের চাষ হতো। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশী ধানের জাত নামে একটা পুস্তক প্রকাশ করে। যার ভেতর বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, বরিশাল, যশোর তত্কালীন ২০টি জেলার ৪৬৭টি থানার ভেতর ৩৫৯টি থানার ইউনিয়ন থেকে ১২৪৮৭টি স্থানীয় ধানের নাম ছিল। বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রায় আট হাজার ধানের জাত সংরক্ষিত আছে। ভৌগোলিক আয়তনে ছোট হলেও প্রায় চার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের দেশে গবেষণা আর উন্নয়নের নামে কত জাতের লুণ্ঠন হয়েছে আর কোন জিনসম্পদ কোথায় কীভাবে ব্যবহূত হচ্ছে তার কোনো পাবলিক হদিস নেই। ধানের জাতবিনাশের ধারাবাহিক পরিসংখ্যান স্পষ্টই প্রমাণ করে আমাদের বীজসম্পদ নিঃশেষ হয়েছে, লুণ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশে চালের উৎপাদন ছিল কোটি টন। বর্তমানে চালের উৎপাদন বছরে প্রায় কোটি ৬০ লাখ টন। চালের যুগান্তকারী উৎপাদনের সঙ্গে কিন্তু কৃষিতে ব্যবহূত বিষ, সিনথেটিক সার কৃষি যন্ত্রপাতির মুনাফা বাণিজ্যকেও হিসাবে আনতে হবে। উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা কত জেনেটিক সম্পদ হারালাম, কতগুলো কেঁচো-মাকড়সা-মাছ-মৌমাছি আর ব্যাঙের মৃত্যু হলো সেই হিসাবও দাঁড় করানো জরুরি। বাংলাদেশে ১৯৫৬ সাল থেকে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রতি বছর তিন টন কীটনাশক এবং ৫০০ স্প্রে ব্যবহার করা হতো। উফশী কি হাইব্রিড সংহারী বীজ চাষে দিনে দিনে বিষের ব্যবহার বাড়ছেই। এমনকি লিচু-আমে বিষ ব্যবহার নিয়ে পাবলিক প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়েছে। লিচুতে বিষ ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর শিশুদের প্রশ্নহীন মৃত্যু ঘটছে। কৃষির অবিশ্বাস্য ফলনের ফলাফল আমরা শরীর মনে প্রতিক্ষণ টের পাচ্ছি। দিনে দিনে নিত্যনতুন অসুখ আর অসুস্থ জল, অসুস্থ জমিন, দূষণ আক্রান্ত পরিবেশ। অথচ আমাদের আদি দেশী জাতগুলোতে যদি আমরা বিশ্বাস, গবেষণা, মনোযোগটা রাখতাম তাহলে নিদারুণ পরিস্থিতিটা কি আমাদের সামাল দিতে হতো? আমরা হয়তো আরো বেশি সময় অর্থ আমাদের দেশ গঠনে, শিক্ষা-বিজ্ঞানের প্রসারে সংস্কৃতি বিকাশে বিনিয়োগ করতে পারতাম। এখন তো একদিকে জমিনে ঢালতে হচ্ছে সিনথেটিক সার, দিনে দিনে বদলাচ্ছে বিষের বোতল। আরেকদিকে অসুখ সারাতে দৌড়াতে হচ্ছে হাসপাতালে।

উফশীর পর হাইব্রিড মিথ্যাচার!

১৯৮৯ সালে ইরি থেকে হাইব্রিড ধানের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে কৃষকদের ভেতর চাষ করানোর জন্য প্যাসিফিক-১১,১৬,২০ এই তিনটি হাইব্রিড ভুট্টার জাত বাংলাদেশ কৃষি ফাউন্ডেশন আমদানি করে থাইল্যান্ড থেকে। ভুট্টা ফলেনি, জমিনের স্বাস্থ্যহানি হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ভারত থেকে দেশের জাতীয় বীজনীতিকে আড়াল করে ২৭০ কেজি হাইব্রিড-৬২০১ ধানবীজ আমদানি করা হয়। ১৯৯৮ সালে দেশে বন্যাপরবর্তী খাদ্যশস্যের ঘাটতি এড়াতে জাতীয় বীজ বোর্ড বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে ২২০০ টন হাইব্রিড বীজ আমদানির সুযোগ করে দেয়। কয়েকটি সিড কোম্পানিকে কিছু চুক্তি শর্তসাপেক্ষে হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তারা কেউ শর্ত মানেনি। আজ দেশের সবজি বীজের পুরোটাই বহুজাতিক কোম্পানির প্যাকেটজাত হাইব্রিড বীজের দখলে। হাইব্রিড ঝলক ধান, আলোক ধান চাষ করে কৃষক নিঃস্ব হয়েছে। ২০১০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়িতে একটি বহুজাতিক কোম্পানির হাইব্রিড সবল টমেটো বীজ চাষ করে প্রতারিত কৃষকেরা বহুজাতিক কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তত্কালীন জনপ্রতিনিধি বিষয়টি সংসদেও উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন নিশ্চুপ থেকে বহুজাতিক কোম্পানিটি আবারো টমেটো বীজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

সবুজ বিপ্লবের মৃত্যুঘণ্টা, আসছে জিন-বিপ্লব

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ইরি) পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ইরির তত্কালীন মহাপরিচালক রবার্ট এস জিগলার বাংলাদেশে এসে জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিকৃত (জেনিটিক্যালি মডিফাইড/জিএমও) শস্যফসলের সাফাই গেয়েছিলেন। বলেছিলেন, জিএমও ফসল পরিবেশবান্ধব। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দুনিয়ার প্রাণ-প্রতিবেশে যে অসহনীয় দূষণ বিশৃঙ্খলা ঘটেছে তা আজ বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। তো সেই উফশী, হাইব্রিডের পর আবার কেন জিএমও তর্ক উঠেছে বিশ্বব্যাপী। কেন প্রতিটি ভূগোলের আদি দেশী জাত লোকায়ত জ্ঞাননির্ভর প্রাকৃতিক কৃষিচর্চা নয়? বাংলাদেশও জেনেটিক্যালি মডিফাইড বিটিবেগুন ছাড়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক জিন-বিপ্লবের ময়দানে প্রবেশ করেছে। চলছে গোল্ডেন রাইস বিটি তুলার ছাড়প্রক্রিয়া। বিটিবেগুন কৃষকসমাজে কোনোভাবেই সমাদৃত হয়নি। কিন্তু বিটিবেগুন গবেষণার মাধ্যমে কী হয়েছে? বিটিবেগুন গবেষণার প্রকল্প চুক্তি মোতাবেক দেশের নয়টি আদি দেশী বেগুন জাতের ওপর বহুজাতিক একটি কোম্পানির পেটেন্ট অধিকার তৈরি হয়েছে। আমাদের নয়টি জনপ্রিয় বেগুন জাতের জিন-মানচিত্রকে জোর করে বদলে ফেলা হয়েছে। ষাটের দশকে দুনিয়ার বীজবৈচিত্র্য দখল লুণ্ঠনে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল ফোর্ড ফাউন্ডেশন রকফেলার ফাউন্ডেশন। আজকে আবার ফাউন্ডেশন কনসোর্টিয়ামরা বৈশ্বিক বীজ কৃষি গবেষণায় পুঁজি বিনিয়োগ করছে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন জলবায়ু সহনশীল বীজ উদ্ভাবনে বিশাল পুঁজি বিনিয়োগ করছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আজ ক্লাইমেট রেডি জিনের নামে একের পর এক জাত পেটেন্ট করে চলেছে। এখন আর জাত নয়, চলছে জিন দখলের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা রাজনীতি।

বীজ সুরক্ষায় জাগো বাংলাদেশ

বাংলাদেশ কৃষিসভ্যতার এক ঐতিহাসিক আখ্যান। পৃথিবীর প্রথম বেগুন গবেষণা শুরু হয়েছিল জামালপুরের চৈতন্য নার্সারিতে। পৃথিবীর প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা কেন্দ্রও তৈরি হয়েছিল এখানে, হবিগঞ্জের নাগুড়ায়। বাংলাদেশ পাটের জিন স্বরলিপি উদ্ভাবন করেছে। আমরা চাইলেই পারি, আমাদের আছে কৃষিজিজ্ঞাসার এক ঐতিহাসিক ভিত। আছে বীজ সংরক্ষণে গ্রামীণ নারীর স্বীকৃতিহীন দীর্ঘ ইতিহাস। বীজের জন্য আমরা কেন কোম্পানির চোখরাঙানির দিকে চেয়ে থাকব। আমরা গ্রামে গ্রামে আমাদের স্বনির্ভর বীজঘর গড়ে তুলব। আমাদের কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) আছে, আমাদের দেশীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় আর অবিস্মরণীয় সব কৃষক বিজ্ঞানী আছেন। হরিপদ কপালী, ফকুমার ত্রিপুরা, মকবুল হোসেন, রঞ্জু মিয়া, নুয়াজ আলী ফকিরের মতো মানুষের হাতেই যুগে যুগে গড়ে উঠেছে কত নামের জাত, কত বৈচিত্র্য। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা আমাদের বীজের রূপ রূপান্তর আমাদের কৃষিপরিসর থেকেই দেখতে চাই। আমাদের ভূগোল আর পারস্পরিক প্রতিবেশ সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। এজন্য দরকার আমাদের বীজচিন্তার মৌলিক পরিবর্তন। বীজসম্পদ নিয়ে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ইশতেহার। দেশের বীজপ্রশ্নকে ঘিরে দরকার নতুন প্রজন্মের সত্যিকারের জাগরণ। দেশে এখনো প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। দেশের প্রায় ৩০ ভাগ তরুণ যুবসমাজ। কিন্তু নতুন প্রজন্ম দিন দিন কৃষিবিমুখ কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। শহরের কথা বাদ দিলাম, গ্রামের প্রায় নব্বই ভাগ নতুন প্রজন্ম দশটি দেশী জাতের নাম বলতে পারে না। শতকরা আশি ভাগ জানে না কোন বীজ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। তাহলে কে ধরবে ভবিষ্যৎ বীজসম্পদ সুরক্ষার হাল? প্রশ্নটিই আজ দেশের বীজ পরিসরের মৌলিক জিজ্ঞাসা হওয়া জরুরি। কারণ দেশের বীজসম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রজন্মই আবার বড় হয়ে মনস্যান্টো বা সিনজেনটা কোম্পানিতে চাকরি করবে কিংবা কেউ হয়তো নিজেই বীজ-মাফিয়া হয়ে উঠবে। তাহলে কীভাবে সার্বভৌম হবে দেশের বিশাল বীজ খাত? দেশের বীজ খাতে কোনোভাবেই কোনো বহুজাতিক দখল কর্তৃত্ব মেনে নেয়া যায় না। দেশের বীজশিল্প বিকশিত হবে দেশের কৃষকসমাজ আর তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। আজকে অনেক তরুণ নিরাপদ অর্গানিক কৃষির আন্দোলন করছে, নিজেরাই উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছে। ধারা আমাদের আশা জাগায়। বীজ খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ মনোযোগ বাড়ুক, সুস্পষ্ট হোক রাষ্ট্রের বীজচিন্তা। জাগুক নতুন প্রজন্ম, জাগাক কৃষির রুদ্ধ দুয়ার। আর কৃষির প্রাণভোমরাই হলো বীজ। নতুন প্রজন্মের ভেতর দিয়েই রূপ, রূপান্তর ঘটুক বাংলার বীজসম্ভারের। রচিত হোক জনগণের বীজ-সার্বভৌমত্ব।

 

পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন