গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটিতে অপরাধপ্রবণ হচ্ছে কিশোররা

নিহাল হাসনাইন

করোনাকালে কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। দীর্ঘকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা বা কাজে যাওয়ার চাপ না থাকায় তাদের মধ্যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থাটির আশঙ্কা, এখনই নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ভবিষ্যতে কিশোরদের মাধ্যমে বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটিত হতে পারে। অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিশোর গ্যাংগুলোকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকাসহ ১২ দফা সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি।

কিশোর গ্যাং নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, রাজধানী ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের এখন ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র ব্যবসা, পাড়া-মহল্লায় নারী কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করা, খুনখারাবি ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে। কখনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবস্থান করে বা কখনো সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ব্যবহূত হয়ে তারা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন স্থানে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তাদের মাধ্যমে বড় অপরাধমূলক ঘটনা সংঘটনের আশঙ্কা রয়েছে।

করোনাকালে কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার হিসাবে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, গত ২৫ মার্চ মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গার্মেন্টস কল-কারখানাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে শিল্প-কারখানা চালু হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ার চাপ নেই। উপরন্তু কর্মজীবী কিশোরদের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে পড়ায় তারাও এখন পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে আড্ডা দেয়াসহ বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা খুন-জখমের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পাড়া-মহল্লার নারী কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করার পাশাপাশি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে গ্যাং তৈরিসহ নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। সম্প্রতি এমনই কিছু কিশোর গ্যাংসংশ্লিষ্ট ঘটনায় ঢাকা মহানগরীর কামরাঙ্গীরচর নারায়ণগঞ্জে খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।

বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান . জিয়া রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, কিশোরদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে অনেক বেশি অপরাধপ্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে মনে হচ্ছে, পরিবার থেকে তারা যথেষ্ট সময় পাচ্ছে না। পাশাপাশি করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় কিশোরদের মধ্যে আড্ডা দেয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কিছু মিলেই কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।

ঢাকায় আকস্মিকভাবে মাথাচাড়া দেয়া কিশোর গ্যাং সংস্কৃতির হটস্পট হিসেবে রাজধানীর ১০টি এলাকাকে শনাক্ত করেছে সংস্থাটি। এলাকাগুলো হলো ডেমরা, সূত্রাপুর, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, উত্তরা পশ্চিম, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান টঙ্গী। এসব এলাকায় ৩২টি কিশোর গ্যাং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান এবং করোনার কারণে মাঝখানে কিছুদিন কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কম দেখা গেলেও বর্তমানে আবারো তাদের তত্পরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কয়েকদিনের অনুসন্ধান শেষে তৈরি করা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের কিশোরদের মধ্যে গ্যাং সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। একই স্কুলের সহপাঠী বা একই পাড়া-মহল্লায় বসবাসকারী কিশোর-তরুণরা একত্র হয়ে চটকদার নাম দিয়ে ভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। আবার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে এসব গ্যাংয়ের নামও ছড়িয়ে দেয়া হয়। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ফেসবুক ইন্টারনেটে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনাসহ মাদকাসক্তি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীতে বর্তমানে এমন ৩২টি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ৫০০ থেকে ৫৫০ কিশোর। এসব গ্যাং একটি আরেকটির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে সংঘর্ষ-খুনোখুনির মতো ঘটনাও ঘটছে।

গোয়েন্দা সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত বছর এমন গ্যাংভিত্তিক বিবাদে খুন হয় পাঁচ কিশোর। আর বছরের প্রথম আট মাসেই খুন হয়েছে সাত কিশোর। এর মধ্যে গত ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের বিবাদে কদমরসুল স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম ওরফে নিহাদ (১৮) বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিসান আহমেদ (১৫) নামে দুই কিশোরের নিহত হওয়ার ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।

অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠা কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ১২ দফা সুপারিশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে কিশোর গ্যাং নির্মূলে গ্যাংগুলোর হটস্পট চিহ্নিতকরণে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের স্বাভাবিক সুশৃঙ্খল জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকভাবে সংশোধনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এছাড়া কিশোর-কিশোরীরা যাতে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক করার বিষয়েও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

তবে পুলিশ বলছে, অন্যান্য সময়ের তুলনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বণিক বার্তাকে প্রসঙ্গে বলেন, বিভিন্ন স্থানে ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। তার পরও তাদের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো একই ধরনের কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে। পুলিশ চেষ্টা করছে, কিন্তু শুধু আইন প্রয়োগ করে এর সমাধান সহজ নয়। এর সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা ধরনের বিষয় জড়িত রয়েছে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা থাকা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন