দূষণ ও দারিদ্র্য নিরসনে ‘আগ্রাসী আগাছা’ কচুরিপানা

বণিক বার্তা অনলাইন

পানির ওপর ভেসে থাকা সবুজ সরস পাতা ও বেগুনি ফুলের সঙ্গে কচুরিপানা দেখতে সুন্দর লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এ উদ্ভিদটির মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। আগ্রাসী এ উদ্ভিদ প্রজাতিটি আঠারো শতকের শেষ দশকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকায় আনা হয়। এরপরই উদ্ভিদটি হ্রদ ও নৌপথে জট লাগিয়ে ফেলে, নষ্ট করে বাস্তুসংস্থান এবং বহু মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে।

অর্থনীতিতে কচুরিপানার প্রভাব সম্পর্কে সাম্প্রতিক কোনো তথ্য নেই। তবে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালে উদ্ভিদটির উপদ্রবে দেশটির ২ লাখ মানুষের বার্ষিক আয় প্রায় ৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার হ্রাস পেয়েছিল। 

এর কয়েক দশক পর ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বেনিনের একটি স্টার্টআপ উদ্যোগ উদ্ভিদটির বিস্তার রোধে কাজ শুরু করে। গ্রিন কিপার আফ্রিকা নামের ওই সংস্থাটি জলপথ থেকে কচুরিপানা উঠিয়ে ফেলে এটির বিস্তার হ্রাস করার চেষ্টা করছে। কেবল তাই নয়, কচুরিপানাগুলো পানি থেকে উঠিয়ে সংস্থাটি সেগুলো একটি তন্তুময় বস্তু তৈরিতে ব্যবহার করছে। এটা তেল ছড়িয়ে পড়া রোধসহ শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করতে পারে। 

এই কাজের পেছনে সংস্থাটির দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে বলে জানান গ্রিন কিপার আফ্রিকার বাণিজ্যিক পরিচালক জেনেভিভ ইয়েহোনমি। তিনি সিএনএনকে বলেন, প্রথমত পরিবেশ থেকে কচুরিপানাকে দূর করা এবং দ্বিতীয়ত এমন একটি শোষণকারী সরবরাহ করা, যা শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যেতে পারে। 

স্টার্টআপটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বের লেক নোকুয়ে পানি পরিষ্কারে কাজ করছে। সেখানে উদ্ভিদটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে সত্যিকারের উপদ্রব। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল, অথচ কচুরিপানার কারণে তাদের মূল জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রথমত ঘন এই আগাছাগুলো মাছ ধরার অঞ্চলগুলোতে যেতে বাধা দেয় এবং পানিতে সূর্যের আলো ও অক্সিজেন প্রবেশে বাধা দিয়ে মাছের বংশবিস্তার হ্রাস করে।  

এছাড়া পানাগুলো নদী ও সেচের খালগুলোতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহে বাধা দিয়ে বর্ষাকালে বন্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটা সমৃদ্ধ ও ভঙ্গুর বাস্তুসংস্থানকে বিপন্ন করে এই অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলও দখল করছে। 

গ্রিন কিপার আফ্রিকা কচুরিপানাগুলো পানি থেকে তুলে রোদে শুকায় এবং এটাকে ভেঙে জিকেএসওআরবি (জৈব শোষক) হিসেবে বাজারজাত করে। এটি দিয়ে ব্যাগ, বালিশ ও মোজার মতো আকৃতি দিয়ে বাজারজাত করা হয়। এই শোষক পণ্য জরুরি স্পিল কিট (তেল পরিষ্কারক) হিসেবে বাজারজাত করা হয়, যা কোনো স্থানে বা গাড়িতে রাখা যায় এবং এটি ২২০ লিটার পর্যন্ত তরল শুষে নিতে সক্ষম। 

ইয়েহোনমি বলেন, পুমা এনার্জি বেনিনের মতো তেল ও গ্যাস সংস্থাগুলো পণ্যটি কিনে নেয়। আমরা বিদ্যমান পদ্ধতির একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প সরবরাহ করছি।

ইন্টারন্যাশনাল ট্যাংকার ওনার্স পলিউশন ফেডারেশনের সিনিয়র টেকনিক্যাল উপদেষ্টা মিগুয়েল প্যাটেল বলেন, বিস্তৃত এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়লে সেক্ষেত্রে সাধারণত বুম, স্ক্রিমার বা ভ্যাকুয়ামের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিষ্কার করা হয়। আর লুজ সরবেন্ট ব্যবহার করা হয় বিশেষত মাটিতে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কারের জন্য। তেল সংস্থাগুলোর ব্যবহৃত সচরাচর সরবেন্টগুলো সিন্থেটিক। সেক্ষেত্রে জৈব সরবেন্ট অবশ্যই উপকারী, কারণ প্লাস্টিকভিত্তিক তন্তু পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া জৈব সরবেন্টগুলো বর্জ্য কম উৎপাদন করে। 

কিন্তু প্রতিবছর ৩ হাজার ৯০০ টন কচুরিপানা সংগ্রহ করা সত্ত্বেও সমস্যার সমাধানে স্টার্টআপটি খুব সামান্যই অবদান রাখতে পারছে। জলজ এ আগাছাটি এত দ্রুত বংশবিস্তার লাভ করে যে একদল কচুরিপানা দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে দ্বিগুণ জায়গা দখল করে নিতে পারে। 

কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য যুক্তি দেখান, উদ্ভিদটির বাণিজ্যিক ব্যবহার সন্ধ্যান এটি নির্মূল করতে সহায়তা করবে না। সেন্টার ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনালের ক্ষতিকর প্রজাতির আঞ্চলিক সমন্বয়কারী আর্ন উইট বলেছেন, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষতিকর উদ্ভিদের ব্যবহার কখনোই তার নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখেনি। প্রকৃতপক্ষে এটা আরো ছড়ানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। কারণ লোকেরা তখন এটিকে এমন কিছু হিসেবে দেখবে, যার মাধ্যমে তারা মুনাফা করতে পারে। তাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্যটি হওয়া উচিত, উদ্ভিদটিকে যতটা সম্ভব সরিয়ে ফেলা। বিপরীতে এটার ব্যবহার গৌণ হওয়াই শ্রেয়।

তবে জেনেভিভ ইয়েহোনমি এটার সঙ্গে সামাজিক উন্নতি দেখছেন। তার দাবি, এ উদ্যোগ আগাছা সরিয়ে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজটি আরো কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রমও হাতে নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সিএনএন অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন