পায়রা বা মাতারবাড়ী কোনোটাই গভীর সমুদ্রবন্দরের গভীরতা পাচ্ছে না

তাসনিম মহসিন

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরগুলোয় কমপক্ষে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নোঙর করে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজই প্রাধান্য পাবে অনেক বন্দরে। যদিও ধরনের জাহাজ চলাচলের জন্য যে গভীরতা প্রয়োজন তা নেই বাংলাদেশের কোনো সমুদ্রবন্দরেরই।

দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে মাতারবাড়ীকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এখন পর্যন্ত। পটুয়াখালীর পায়রায়ও একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দুটি বন্দরের কোনোটিরই নেই গভীর সমুদ্রবন্দর করার মতো গভীরতা। মাতারবাড়ী বন্দরকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য বিবেচনা করা হলেও বন্দরটির সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা ১৩ দশমিক মিটার। আর পায়রা বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা ১৪ মিটার। অঞ্চলের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর সিঙ্গাপুরের গভীরতা ২৪ দশমিক মিটার, যার ধারেকাছেই নেই মাতারবাড়ী পায়রা।

পায়রা বন্দরের মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ করছে নেদারল্যান্ডসের রয়েল হাসকনিং ডিএইচভি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণা, পরীক্ষা পরামর্শক ব্যুরো (বিআরটিসি) পায়রা বন্দর নিয়ে কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনায় একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান তৈরিও করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সেখানে বন্দরের উন্নয়ন ভিশন, বাজার পূর্বাভাস, অবকাঠামো নির্মাণ এবং বন্দর উন্নয়ন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া অঞ্চলের বন্দরগুলোর সর্বোচ্চ গভীরতার সক্ষমতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেও দেখানো হয়েছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যমান সমুদ্রবন্দর দুটির মধ্যে মোংলা বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা মিটার, আর চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সক্ষমতা দশমিক মিটার। অন্যদিকে নির্মাণ হতে যাওয়া মাতারবাড়ী পায়রার গভীরতা সক্ষমতাও ১৪ মিটারের বেশি নয়, যা গভীর সমুদ্রবন্দর বিবেচনায় খুবই অপর্যাপ্ত। কারণ যে ড্রাফটের জাহাজ গভীর সমুদ্রবন্দরে চলাচল করে সেগুলো এসব বন্দরে ভিড়তেই পারবে না।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা মাস্টারপ্ল্যানে বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজগুলো নিয়ে বাংলাদেশের জন্য দুই ধরনের জাহাজকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য দশমিক থেকে ১২ দশমিক শূন্য মিটারের জাহাজ এবং অন্য বন্দরের জন্য ১০-১৪ মিটার ড্রাফটের প্যানাম্যাক্স ক্লাসের জাহাজের কথা বলা হয়েছে এতে। পরিকল্পনা প্রতিবেদন তৈরির সময়ে আমদানি-রফতানিতে জাহাজ পরিচালনাকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে। তাদের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ মান হিসেবে প্যানাম্যাক্স ক্লাসের জাহাজের কথা বলা হয়েছে। বন্দরের উন্নয়ন কৌশল প্রস্তুতে বন্দর ব্যবহারকারীদের আয়-ব্যয়ের দিকটিও বিবেচনায় রেখেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।

পরামর্শক দলের এক বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যে পরিকল্পনাটি দেয়া হয়েছিল তা মন্ত্রণালয়ের পছন্দ হয়নি। তাই আমরা আবারো একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই, যা আছে নদীবন্দর। কারণ প্রতিটি বন্দরই নদীর ভেতরে। ফলে আমাদের পরামর্শ ছিল নদী থেকে বের হয়ে সমুদ্রে বা অফশোরে বন্দরটি নির্মাণ করার, যা বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণে উপযোগী হতো।

তার ভাষ্য, একটি গভীর সমুদ্রবন্দর হতে কমপক্ষে ১৮ মিটারের গভীরতা প্রয়োজন। কিন্তু অনশোর বা ডাঙায় বন্দরটি হলে তা গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার জন্য উপযোগী নয়।

দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বন্দরের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন

বিপুল অর্থ ব্যয়ে পায়রায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার জন্য অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে বড় ধরনের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন পড়বে। পাশাপাশি নিয়মিত ড্রেজিংও করতে হবে। জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) মতে, এজন্য ব্যয় হবে বছরে আরো ৩০-৫০ কোটি ডলার। বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও খুবই সীমিত পরিসরে ব্যবহার হবে বন্দরটি। ২০৪১ সালে পায়রা বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হবে সাড়ে পাঁচ লাখ টিইইউএসেরও কম। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানেই বার্ষিক ২৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনার পরিবহন হয়। আর ২০৪১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৯ লাখ টিইইউএস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়রা বন্দরের ১৪ মিটার গভীরতা চাইলে পুরো চ্যানেলটিতেই পরিমাণ গভীরতা লাগবে। কিন্তু পায়রা বন্দর যেতে যে পথটি ব্যবহার করা হবে বা অ্যাপ্রোচ ওয়ে সেখানে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরতা খুবই কম। সেখানে যে পরিমাণ খনন করতে হবে তা বছরব্যাপী বন্দরে জাহাজ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করবে।

এদিকে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর চূড়ান্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে জাইকা। ওই প্রতিবেদনে পায়রাসহ মাতারবাড়ী চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের তুলনামূলক প্রাক্কলন করেছে সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, ২০২৬ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহন হবে ৩৪ লাখ হাজার টিইইউএস। ওই সময় পায়রা বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হবে মাত্র লাখ ৮০ হাজার ৫২৬ টিইইউএস। বরং পায়রার চেয়ে মাতারবাড়ীতে কনটেইনার পরিবহন হবে বেশি, লাখ ৯৯ হাজার টিইইউএস।

জানতে চাইলে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর হবে না। গভীর সমুদ্রবন্দর একটাই সেটা মাতারবাড়ীতেই হবে। এখন বিকল্প আমরা চিন্তা করছি না। পায়রায় ফাস্ট টার্মিনালের কাজ চলছে। আনুষঙ্গিক জেটি নির্মাণের টেন্ডার হয়ে গেছে। মাতারবাড়ীর যে প্রজেক্ট আছে সেখানেই গভীর সমুদ্রবন্দর হবে। প্রজেক্ট শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পরবর্তী কোনো চিন্তাভাবনা আমরা করছি না।

উল্লেখ্য, পায়রা বন্দরকে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল, তৈরি পোশাক, ঔষধ শিল্প, সিমেন্ট, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মত্স্য প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তৈল শোধনাগার জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ মোট ১৯টি কমপোনেন্ট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পায়রা বন্দর উন্নয়নে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ, রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইবাল্ক/ কোল টার্মিনাল নির্মাণ, ভারতীয় ঋণসহায়তায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ট্রান্সশিপমেন্ট কনটেইনার টার্মিনাল, ডিপ ওয়াটার কনটেইনার টার্মিনাল, অফসোর টার্মিনাল/ সাপ্লাইবেস, কোর পোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, হাউজিং এডুকেশন হেলথ ফ্যাসিলিটিজ, টাওয়েজ হারবার টাগস, ইন্টারনাল ফেরি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিমানবন্দর, পায়রা বন্দরের রেল সংযোগ, শিপইয়ার্ড শিপ মেরামত কার্যক্রম, লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশ সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব নিরূপণ, ক্রয় পরিকল্পনা ক্রয় প্রস্তাব প্রণয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টগুলো বুয়েটের বিআরটিসির নেতৃত্বে রয়েল হাসকনিং ডিএইচবির সহায়তায় প্রণীত হবে। পোর্ট অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান এবং কৌশলগত ট্যারিফ প্ল্যান প্রণয়ন এবং গভীর সমুদ্রবন্দরে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন