সংক্রামক জীবাণুতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সাধারণত ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (যাকে আমরা ইমিউনিটি বলি) তৈরি হয়।
এ ধরনের প্রতিরক্ষার মেয়াদ জীবাণুভেদে কমবেশি হতে পারে।
এখন এই ইমিউনিটির স্থায়িত্বকালের সঙ্গে শুধু যে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া বা না হওয়ার সম্ভাবনা জড়িত, তা নয়।
বিশেষ করে কোনো মহামারীর সময়ে এই বিষয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি।
করোনাভাইরাসের চলমান মহামারী সহসাই নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ এখনো দৃশ্যমান নয়।
তাই বাধ্য হয়েই বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের ‘ইমিউনিটি পাসপোর্ট’
বা ‘হার্ড ইমিউনিটি’র মতো অপ্রচলিত ব্যবস্থার কথা ভাবতে হচ্ছে।
কিন্তু এই দুটো ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপস্থিতি।
সর্বোপরি, এর সঙ্গে পৃথিবীব্যাপী করোনা মহামারী কতদিন স্থায়ী হতে পারে, তার ওতপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান।
তাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদে ইমিউনিটি তৈরি করে কিনা, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি।
এক্ষেত্রে চিন্তার বিষয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণে দীর্ঘমেয়াদে ইমিউনিটি তৈরি হয় কিনা, এখনই এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া কি আদৌ সম্ভব? যেমন কোনো ইনফেকশনের কারণে ইমিউনিটি তিন বছর স্থায়ী হবে কিনা এটি আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিকে তিন বছরের আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
কিন্তু তার পরও কোনো বিকল্প পন্থায় কি এর উত্তর দেয়া সম্ভব?
এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য প্রথম হাই-প্রোফাইল গবেষণাপত্র বের হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে বিখ্যাত জার্নালগুলোর একটি ‘সায়েন্স’-এ।
নয়টি বানরের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় বানরগুলোকে পরীক্ষামূলকভাবে করোনাভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত করা হয়।
এর এক মাসেরও অধিক সময় পর বানরগুলোকে পুনরায় করোনাভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ করা হলে শুধু কয়েকটি ক্ষেত্রে অল্পকিছু ভাইরাসের উপস্থিতির সঙ্গে মৃদু লক্ষণ প্রকাশ পায়।
কিন্তু প্রথমবারের মতো করোনার পূর্ণ লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, যা থেকে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছান যে করোনাভাইরাসের একবার সংক্রমণ পরবর্তী সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।
চায়নাতে চারটি বানরের ওপর চালানো আরেক গবেষণায় একই ধরনের ফল পাওয়া যায়।
এ তথ্য সারা বিশ্বেই গবেষকদের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির পাশাপাশি প্রাকৃতিক ইমিউনিটি তৈরি হওয়া নিয়ে আশাবাদী করে তোলে।
আর এই আশাবাদের ওপর ভিত্তি করেই দীর্ঘমেয়াদে করোনা মোকাবেলায় ‘ইমিউনিটি পাসপোর্টের’
কথা উঠে আসে, যার অর্থ হলো যাদের এরই মধ্যে করোনার বিরুদ্ধে ইমিউনিটি আছে, তাদের কাজে লাগিয়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করা।
কিন্তু এ আশাবাদ নিয়ে বারবারই সন্দেহ জেগেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বারবার এমন সংবাদ এসেছে যে আক্রান্ত ব্যক্তি একবার সুস্থ হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর আবার করোনার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয়, দ্বিতীয়বার লক্ষণ প্রকাশের সময় করোনা শনাক্তকারী আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় অনেক ক্ষেত্রে পজিটিভ রেজাল্ট দিয়েছে।
কিন্তু দিনশেষে মিডিয়ায় বারবার গুরুত্ব সহকারে প্রচার পাওয়া ঘটনাগুলো এখনো পর্যন্ত ফলস পজিটিভ হিসেবেই গবেষকদের মধ্যে গণ্য হচ্ছে।
কিন্তু এ ব্যাখ্যা যে আসলে সবার মনের সন্দেহ দূর করতে পারেনি, এটা পরিষ্কার।
আর এই সন্দেহ থেকে নতুন এক প্রশ্নের উদ্রেক হলো যে যদি করোনার প্রাকৃতিক সংক্রমণে ইমিউনিটি তৈরি না হয়, তাহলে করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কি আদৌ কোনো কাজে আসবে?
এর উত্তর কিছুটা পাওয়া গেল মডার্নার উদ্যোগে তৈরি হতে যাওয়া ভ্যাকসিনের ফেজ-১ পরীক্ষায়, যেখানে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন গ্রহণ করা মানুষদের রক্তে স্বাভাবিক ইনফেকশনের সমান বা তার চেয়ে বেশি অ্যান্টিবডি পাওয়া গেল।
এতে করে গবেষকরা আরেকবার আশ্বস্ত হলেন যে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
কিন্তু একটা প্রশ্ন কিছুতেই মাথা থেকে সরছিল না যে এই অ্যান্টিবডি আক্রান্ত মানুষের দেহে কতদিন স্থায়ী হবে?
এ প্রশ্নের উত্তর কিছুটা পাওয়া গিয়েছে নেচার মেডিসিনে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় যেখানে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডির মাত্রা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে অনেকখানি কমে আসে।
তার সঙ্গে এটাও দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত হয়েও যাদের লক্ষণ প্রকাশ পায় না, তাদের রক্তে আরো দ্রুত অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে থাকে।
এতে করে পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সার্স-কোভ-২ ছাড়া অন্য আরো যে চার প্রকার করোনাভাইরাস পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা সাধারণত এক বছরের কম সময় স্থায়ী হয়।
তার মানে, সার্স-কোভ-২ যদি অন্য করোনাভাইরাসের মতো আচরণ করে, তাহলে ধরে নেয়া যায় যে এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি এক বছরের বেশি স্থায়ী হবে না হয়তোবা, যা সম্প্রতি নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তার মানে, ইমিউনিটি পাসপোর্ট বা হার্ড ইমিউনিটি ঘিরে যে আশাবাদ বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিদ্যমান, তা উবে যাওয়ার জোগাড়।
সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে এই বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হওয়ায় এ নিয়ে সবার মধ্যে এক ধরনের নতুন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কিন্তু আসলেই কি বিষয়টা এতটা সহজে বলে দেয়া যাবে?
একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দেয়ার জন্য তার দেহে যে কয়টি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা তৈরি হয়, রক্তে উপস্থিত অ্যান্টিবডি তার মধ্যে শুধুই একটা উপাদান।
কিন্তু রক্তে দ্রবীভূত অ্যান্টিবডি ছাড়াও আরো কিছু বাড়তি ব্যবস্থা থাকে (যেমন ‘হেল্পার-টি সেল’
এবং ‘কিলার-টি সেল’,
যারা এক বিশেষ ধরনের প্রতিরক্ষাদানকারী রক্তকণিকা)। এ বিষয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রথম সারির আরেকটি জার্নাল ‘সেল’-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে সক্রিয় এই দুই ধরনের কণিকার উপস্থিতি ভালোভাবেই পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, এর কিছুদিন আগে, নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়ান আরেকটা গবেষণায় একই ধরনের ফল পাওয়া গিয়েছিল।
সেল-এ প্রকাশিত গবেষণায় এমনকি এটাও পাওয়া গিয়েছে যে সার্স-কোভ-২ ছাড়া অন্য করোনাভাইরাসে এর আগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে এমন হেল্পার-টি সেল থাকে, যা সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়।
অত্যন্ত আশাপ্রদ বিষয়, আরেক প্রথম সারির জার্নাল ‘নেচার রিভিউ ইমিউনোলজি’তে প্রকাশিত গবেষয়ায়ও ঠিক একই ফল পাওয়া গিয়েছে।
অতএব, সার্স-কোভ-২-এ আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডি ছাড়াও নিশ্চিতভাবেই অন্য আরো উপাদান থাকে, যা ওই ব্যক্তিকে দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দিতে ভূমিকা পালন করতে পারে।
তাহলে মোটের ওপর বিষয়টা কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এটাই যে সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির পরিমাণ খুব বেশিদিন স্থায়ী না-ও হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রতিরক্ষা এই ব্যক্তির থাকবে না, এ কথা আগেভাগেই বলে ফেলা সমীচীন হবে না।
আরো কিছুদিন সময় পর হয়তো বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে আরেকটু ভালোভাবে আমাদের জানাতে পারবেন।
ইমিউনিটির মেয়াদের এই বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য এ মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রোগীদের সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের যেমন এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা জরুরি, জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদেরও তেমনি এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
ঠিক একই কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রতিক তৈরি হওয়া আতঙ্ক নিরসনে এ তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আশা করি ওপরের আলোচনাটি সবার জন্য কিছুটা হলেও কাজে দেবে।
ধন্যবাদ।
লেখক : অণুজীববিজ্ঞানী
ও জনস্বাস্থ্য গবেষক;
কো-অর্ডিনেটর, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]