১০০ দিনেরও বেশি সময় গৃহবন্দি রয়েছেন আলোকচিত্রী সরকার প্রতীক। ঘরে বসে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া ও নিজের কাজের মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের হিস্ট্রিক্যাল ও কলোনিয়াল আর্কিটেকচার নিয়ে গবেষণা করছেন। কাজ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা থাকলেও কভিড-১৯ যেন সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। সম্প্রতি টকিজের মুখোমুখি হয়ে নিজের কাজ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন রাইসা জান্নাত
কেমন আছেন? কতদিন হলো ঘরবন্দি রয়েছেন?
সুস্থ আছি। গৃহবন্দি থাকার ১০০ দিন হয়ে গেছে। বাসায় এভাবে একটানা থাকা সহজ নয়। আমরা মানুষেরা এতে অভ্যস্ত নই। এ কারণে মানসিকভাবে কিছুটা প্রভাব পড়ে। তবে দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে অনেক দিক থেকেই আমি ভালো আছি।
দিনের অধিকাংশ সময় কীভাবে কাটছে?
লকডাউনের শুরুর দিকে ছুটির মতো মনে হচ্ছিল। কাজের প্রয়োজনে আমাকে প্রায়ই বাইরে ট্রাভেল করতে হয়। সাধারণত দুই সপ্তাহের বেশি বাসায় থাকা হয় না। তাই প্রথম মাসটা উত্তেজনা, ভয় ও হতাশার মধ্য দিয়ে কেটেছে। একই সঙ্গে মানসিকভাবে একটু বিশ্রামও ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে কাজ বাড়তে থাকে। অনলাইনের এ যুগে দুনিয়া বসে নেই। এছাড়া আমাকে পাঠশালা মিডিয়া ইনস্টিটিউটে পড়াতে হয়। একটা বড় সময় অনলাইনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও ক্লাসের পেছনে চলে যায়। এটা একটা নতুন পরিস্থিতি। শারীরিকভাবে ফিল্ডে যেসব কাজ করা হতো, সেগুলোকে অনলাইনে ট্রান্সফার করা চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয়। এরপর একপর্যায়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ-বিদেশের শিল্পীদের অনলাইনে আমন্ত্রণ জানাই তাদের কাজ নিয়ে আলোচনার জন্য। এ পর্যন্ত নয়টা সেশন হয়েছে। এসব করেই একটা দিনের বড় সময় চলে যায়।
লকডাউনের আগে দেশের বাইরে ছিলেন। তখনকার কাজকর্ম নিয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন?
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে বেশ কয়েকবার ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকায় যেতে হয়েছে। শ্রীলংকায় গিয়েছিলাম তার কারণ একসময় দেশটি ব্রিটিশ ও ডাচ উপনিবেশ ছিল। সেখানে তাদের যে আর্কিটেকচারাল স্থাপনা ও স্পেসগুলো এখনো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা স্টাডি ও ছবি তোলার কাজে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের হিস্টোরিক্যাল ও কলোনিয়াল আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করছি। এ কারণে ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান আমাকে সেখানে পাঠিয়েছিল। সেখান থেকে এসে দুবার নেপালে যাই; আমাদের পাঠশালারই আরেকটি ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি প্রোগ্রামে। এটা একসময় দেশেই হতো। কিন্তু ভিসাসহ নানা জটিলতার কারণে দুই বছর ধরে নেপালে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ১২ মার্চ নেপাল থেকে ফিরে আসি। তার পর থেকে ঘরবন্দি।
আপনি বাংলাদেশের হিস্ট্রিরিক্যাল ও কলোনিয়াল আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করছেন। এ ধরনের কাজের পেছনে আগ্রহের বিষয়টা নিয়ে একটু বলবেন?
এগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য সে রকম আর্কাইভ এখানে নেই। আর্কিওলজি বিভাগের যে ডকুমেন্ট, সেখানে হাতেগোনা কয়েকটা স্থাপনার নাম রয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও প্রচুর জায়গা রয়েছে। এগুলো নিয়ে পড়াশোনার কোনো উপকরণ নেই, ছবিও নেই। মাঝে মধ্যে পুরনো কিছু ছবি দেখা যায়। সেই আগ্রহের জায়গা থেকে কাজটা শুরু করা। দ্বিতীয়ত, স্থাপনাগুলোর সঙ্গে সময়ের একটা সম্পর্ক রয়েছে। রাজপ্রাসাদগুলো ক্ষমতার প্রতীক; ক্ষমতাকে উপস্থাপন করে। কিন্তু এখন এগুলোর অবস্থা অনেক জীর্ণ এবং প্রকৃতির ভেতর বিলীন হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয়, অধিকাংশ আর্কিটেকচার গাছেরা খেয়ে ফেলছে। আসলে আমাদের সৃষ্টি করা সাধনা, যেগুলো দিয়ে ক্ষমতা ও সম্পদের বহিঃপ্রকাশ ঘটাই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর কোনো অর্থই আর থাকে না। সবই প্রকৃতির দখলে চলে যায়। ফিলোসফিক্যাল ধারণাগুলোকে ভিজুয়ালি তুলে ধরার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা সঠিক মনে হয়েছে আমার কাছে।
লকডাউনের এ সময়টায় নিশ্চয়ই অনেক কাজের পরিকল্পনা ছিল?
কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল। সেটা বাতিল হয়েছে। এ মাসে জাপানে যাওয়ার কথা ছিল। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী হওয়ার কথা। কিন্তু এ অবস্থায় যাওয়া হচ্ছে না। তবে এ নিয়ে দুঃখবোধ নেই। পৃথিবীর যে অবস্থা, তাতে এ ধরনের উদযাপনগুলো ক্ষুদ্র লাগে। আমি সুস্থ আছি, এটাই এখন বড় বিষয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কভিড-১৯-এর প্রভাব আরো দীর্ঘ সময় থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে ফটোগ্রাফি কতটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে?
যেকোনো শিল্পমাধ্যমই অর্থনৈতিকভাবে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিশেষ করে যদি আলোকচিত্রীদের কথা বলি, অনেক ধরনের কাজের জন্য তাদের বাইরে যেতে হয়। আবার আলোকচিত্রী তো অনেক ঘরানার। ধরুন যদি শুধু ফটোসাংবাদিকদের কথাই বলি, অগ্নিকাণ্ড, হরতাল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রিফিউজি ক্যাম্প বা যেকোনো সংকটে তারা ছুটে যান। কিন্তু এ সংকটে তা করা খুব কঠিন। এ কারণে আমাদের আসলেই আরো গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন হবে। আমরা আসলে কোনো কাজ কেন করি? এ কাজের দ্বারা কাদের কাছে পৌঁছতে চাই এবং কীভাবে পৌঁছতে পারি? এ বাস্তবতায় কোন বিষয়গুলো আসলেই ভাবা গুরুত্বপূর্ণ? সহজ কিছু হবে না। তবে আমি আশাবাদী, পরবর্তী সময়ে আমাদের চিন্তাধারা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়কেন্দ্রিক হবে।
বর্তমান মহামারীর প্রকোপ এড়াতে ঘরে অবস্থান করতে হচ্ছে। তাহলে একজন আলোকচিত্রী কীভাবে করোনাকালে হিউম্যান কানেকশন বা এক্সপেরিয়েন্সগুলো তুলে ধরার কাজ করবেন?
আমি সময় পেলে টুকটাক কাজ করছি। হয়তো সেগুলো মানুষকেন্দ্রিক হচ্ছে না। আমার ব্যক্তিগত চিন্তাকেন্দ্রিকই হচ্ছে। আমি নিশ্চিত আমার মতো অনেক শিল্পীই তাদের নিজস্ব চিন্তা ও স্থান থেকে এ সময়টা নিয়ে কাজ করছেন। আর মাঝে মাঝে কাজ না করাটাও জরুরি। যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু কাজ করি। কিন্তু এগুলোর সবকিছুই যে অর্থপূর্ণ হবে ও গুরুত্ব বহন করবে তা নয়। এ বিষয়টা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। আমার মনে হয়, এর জন্য অন্তত এক বছর সময় লাগবে। আমাদের মন ও শরীর নির্দিষ্ট সময় পরপর পরিবর্তিত হতে থাকে। আমাদের ভাবনা ও প্রশ্নগুলোও। আমি মনে করি, এটা তাড়াহুড়োর বিষয় নয়। তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে যেমন প্রয়োজনীয় আর ভালো হয় আবার অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীনও হতে পারে। এটা সময়ই বলবে।