ভারতীয় টেলিকম কোম্পানি রিলায়েন্স জিওর ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মালিকানা কিনেছে সোস্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক। গত এপ্রিলে প্রতিদ্বন্দ্বী ফেসবুকের এ অধিগ্রহণের পর থেকে ভারতের টেলিকম খাতে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছে আরো দুই মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগল ও মাইক্রোসফট। খবর ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।
বৈশ্বিক সার্চ জায়ান্ট গুগল ভারতের টেলিকম খাতে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় দেশটির দ্বিতীয় বৃহৎ সেলফোন অপারেটর ভোডাফোন-আইডিয়া লিমিটেডের অন্তত ৫ শতাংশ মালিকানা ক্রয়ের বিষয়ে ভাবছে। অন্যদিকে সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফট ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি নিয়ন্ত্রিত রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (আরআইএল) আওতাধীন রিলায়েন্স জিও প্লাটফর্মে ২০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রিলায়েন্সের ডিজিটাল সেবা বিভাগ হলো জিও প্লাটফর্ম। আর জিও প্লাটফর্মের আওতাধীন টেলিকম কোম্পানি হলো রিলায়েন্স জিও ইনফোকম লিমিটেড। ভারতে এ সেলফোন অপারেটরের গ্রাহক সংখ্যা ৩৮ কোটি ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুগল ভোডাফোন-আইডিয়া লিমিটেড ছাড়াও ভারতে সাড়ে তিন বছর আগে কার্যক্রম শুরু করা টেলিকম কোম্পানি রিলায়েন্স জিওর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। রিলায়েন্স জিও গত কয়েক সপ্তাহে ফেসবুক, প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম সিলভার লেক, জেনারেল আটলান্টিক ও ভিস্তার মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ হাজার ৩০ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহে সক্ষম হয়েছে।
ভারতের ক্রমবর্ধমান টেলিকম খাতে গ্রাহক সংখ্যা বিবেচনায় খুব অল্প সময়ে শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে রিলায়েন্স জিও। জিওর আগ্রাসী ব্যবসা কৌশলের কারণে চাপে রয়েছে বাজারটির অন্য সেলফোন অপারেটরগুলো। যে কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নজর কেড়েছে জিও।
গত এপ্রিলের শেষ দিকে ৫৭০ কোটি ডলারে রিলায়েন্স জিও ইনফোকমের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয় ফেসবুক। ভারতীয় মুদ্রায় এ অধিগ্রহণের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৪৩ হাজার ৫৭৪ কোটি রুপি। ওই সময় ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ বলেন, বিশ্বজুড়ে নিজেদের গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি করতেই জিওর সঙ্গে তাদের এ জোটবদ্ধ হওয়া।
রিলায়েন্স জিওর পৃথক বিবৃতিতে বলা হয়, জিও প্লাটফর্মে বিনিয়োগ করতে চলেছে ফেসবুক। এ নিয়ে একটি চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। ফেসবুকের এ চুক্তির ভিত্তিতে জিওর ডিজিটাল প্লাটফর্মের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি রুপি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণের বোঝা কমাতে বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ব্যবসায় বিলগ্নীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে রিলায়েন্স। এরই অংশ হিসেবে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে সৌদি তেল শোধন সংস্থা আরামকোর কাছে নিজেদের ২০ শতাংশ মালিকানা বেচে দিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে রিলায়েন্স (পেট্রো)। গুগলের সঙ্গেও একটি পৃথক বিলগ্নীকরণের আলোচনা চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জিও প্লাটফর্মের সঙ্গে চুক্তির ফলে ভারতে আরো বিস্তার লাভ করবে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টগুলো। চীনের পর ফেসবুকের সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে ভারতে। এরই মধ্যে ভারতে ৪০ কোটির বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে ফেসবুক নিয়ন্ত্রিত আরেক জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের। জানা যায়, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভারতে আর্থিক লেনদেন সেবা চালু করতে চাইছে ফেসবুক। টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানটিকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছতে সহায়তা করবে। একই ধরনের সুবিধা পেতে ভারতীয় টেলিকম প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব পেতে বিনিয়োগে আগ্রহী গুগল ও মাইক্রোসফটও।
২০১৬ সালে যখন জিওর আবির্ভাব ঘটেছিল, তখন প্রতিষ্ঠানটির একটাই লক্ষ্য ছিল। আর তা হলো ডিজিটাল মাধ্যমে ভারতের উদয় এবং তার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক ভারতীয়র জীবন উন্নত করা। একই সঙ্গে ভারতকে বিশ্বের প্রধান ডিজিটাল সোসাইটি হিসেবে মেলে ধরা।
এ বিষয়ে মুকেশ আম্বানির ভাষ্য, জিওর কার্যক্রম সম্প্রসারণে আমরা ফেসবুকের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছি। আশা করছি, আমাদের যৌথ উদ্যোগ ভারতে ডিজিটাল পরিবেশকে আরো ভালোভাবে মেলে ধরবে এবং ভারতীয়দের জীবনমান আরো উন্নত করবে।
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড়, সাশ্রয়ী ও দ্রুত প্রবৃদ্ধির টেলিকম বাজার। তবে দেশটির টেলিকম খাত টানা কয়েক বছর নজরকাড়া সব অর্জনের পর এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংকটপূর্ণ সময় পার করছে, যা একটি বাজারের সমগ্র চিত্র বদলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। একদিকে সেলফোন অপারেটরগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা, অন্যদিকে তীব্র প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এতে বাড়তি অনিশ্চয়তা যোগ করেছে অ্যাডজাস্টেড গ্রস রেভিনিউর (এজিআর) সংজ্ঞা নিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে চলমান মামলার রায় ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশনের (ডিওটি) পক্ষে যাওয়া।
দেশটির টেলিকম খাতে মূল্যযুদ্ধ মোকাবেলা করতে গিয়ে সেলফোন অপারেটরগুলোর মুনাফা শূন্যের কোটায় নেমেছে। বাধ্য হয়ে গত কয়েক বছরে একাধিক অপারেটর বাজারটি থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে এবং কয়েকটি অপারেটর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে একীভূত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেলফোন অপারেটরগুলোর অর্থ সংকট এবং তীব্র প্রতিযোগিতা ও মূল্যযুদ্ধের কারণে বাজারে যেকোনো সময় পুরো ভিন্ন চিত্র দেখা যেতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জিওর সঙ্গে একাধিক মার্কিন প্রতিষ্ঠানের জোট ভারতের ডিজিটাল সেবা খাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।