চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

করোনাকালে বিপদে শিক্ষার্থীরা, পাশে নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

জোবায়ের চৌধুরী, চবি প্রতিনিধি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শাটল ট্রেনের জন্য রেলওয়ে প্রতি মাসে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। করোনা মহামারীর কারণে অনির্ধারিত দুই মাস বন্ধে অন্তত ১৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয় সংকোচন হয়েছে। শুধু রেল নয়, এমন অনেক সেবাই বন্ধ থাকায় কোটি টাকারও বেশি ব্যয় সংকোচন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। এমন অবস্থায় সঙ্কটে থাকা শিক্ষার্থীদের পাশে না দাঁড়ানোয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। এমনকি ছাত্র কল্যাণ তহবিলের টাকা কোন খাতে ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গেল ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরে গত ১৮ মার্চ থেকে তিন সপ্তাহের ছুটি ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়, পরে তা দফায় দফায় বাড়িয়ে এখনও চলমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল দাপ্তরিক অফিসও বন্ধ রাখা হয়েছে। হঠাৎ নেমে আসা এ দুর্যোগে গত দুই মাসের মেস ও ‘কটেজ’ ভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের আশপাশে গড়ে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনে পরিচালিত মেসগুলো কটেজ নামে পরিচিত। এমনকি ভাড়া বকেয়া থাকায় চবির ১০ শিক্ষার্থীকে ভিক্ষা করে হলেও তা পরিশোধ করতে বলেন এক বাড়িওয়ালা- এমন খবরও এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী আবাসিক হলে থাকতে পারেন। বাকী শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ক্যাম্পাসের আশপাশের কজেট ও শহরের মেসে বসবাস করেন। ভবন মালিকদের চাপের মুখে এসব সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন বকেয়া ভাড়ার বিষয়টি প্রশাসনকে সমাধানের দাবি জানিয়ে আসছে নিয়মিতই। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ থাকলেও গত ৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ ও ত্রাণ তহবিলে এক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ‘সক্ষমতা অনুযায়ী করণীয়’ ঠিক করবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী দেওয়ান তাহমিদ বলেন, ‘ক্যাম্পাসের কটেজ ও শহরের মেসে যেসব অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা থাকেন, তাদের এই কয়েক মাসের ভাড়ার দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতে হবে। ভাড়ার জন্য যেন শিক্ষার্থীদের কোন চাপ দেওয়া না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ভাড়া মওকুফের দাবি করছি না, প্রশাসন যেন এই দায়িত্ব নেয়। আমাদের দাবিগুলো প্রশাসনকে জানিয়েও কোন সাড়া পাচ্ছি না।’

দুর্দশায় শিক্ষার্থীরা
এই মহামারীতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের বিশাল অংশ বিপদে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির দেয়া দুর্যোগকালীন বিশেষ বৃত্তির আবেদনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিষয়টি। শিক্ষকদের এক দিনের বেতন দিয়ে গঠিত তহবিল থেকে দেয়া এ সহায়তা পেতে আবেদন করেছেন প্রায় ৩ হাজার ২০০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী মাত্র ৩৪৩ জন শিক্ষার্থীকে আড়াই হাজার টাকা করে দিতে পেরেছে শিক্ষক সমিতি। এছাড়া সাবেক এক শিক্ষার্থীর দেয়া অনুদান থেকে আরো ৬০ শিক্ষার্থীকেও এ বৃত্তি দেওয়ার কথা রয়েছে।

শিক্ষক সমিতির একটি সূত্র বলছে, ‘আবেদনের সময় কেন তাকে এই বৃত্তি দেওয়া হবে- তা জানাতে ২০০ শব্দের ব্যাখ্যা লিখতে বলা হয় সবাইকে। আবেদন করা ৩ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগ অবস্থা এমন- কারো বাবা নেই, প্রতিবন্ধী, পরিবারের উপার্জনক্ষম নেই অথবা অসুস্থ। এত শিক্ষার্থীকে সহায়তার সামর্থ্য নেই শিক্ষক সমিতি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। এত শিক্ষার্থী আবেদনের বিষয়টি অপ্রত্যাশিত ছিল।’

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মেস ও কটেজ ভাড়া বিষয়টিকে মুখ্য ইস্যু হিসেবে দেখছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. এমদাদুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। এই অচলাবস্থায় তাদের টিউশনি নেই, ইনকামের পথ বন্ধ। অনেককে আবার নিজেদের পাশাপাশি পরিবারও চালাতে হয়। তাই মেস ও কটেজ ভাড়া নিয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন। এই অবস্থায় সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, অ্যালামনাইসহ সকলের উচিত এগিয়ে আসা।’

তিনি আরো বলেন, ‘বৃত্তির জন্য আমরা আরো তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছি। ছাত্র কল্যাণ তহবিলের টাকা শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করা, কয়েক মাসের বেতন ও আবাসিক হলের ফি মওকুফসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়ে প্রশাসনকে চিঠি দেব আমরা।’

অনেক খাতে ব্যয় সংকোচন

বিশ্ববিদ্যালয়ের গত দুই অর্থ বছরের তথ্যানুযায়ী, প্রতি মাসে রেল ভাড়া বাবদ ব্যয় ৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, পরিবহন জ্বালানী বাবদ ২৫ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, বাস ভাড়া বাবদ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, পরিবহন মেরামত বাবদ ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে প্রতি মাসে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন থেকে পরিবহন খরচ বাবদ ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকাও আদায় করা হয়। গত দুই মাসের অনির্ধারিত বন্ধে এই পুরো টাকাই সংকোচন হওয়ার কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসে গড় বিদ্যুৎ খরচ ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সকল ভবন, আবাসিক হল বন্ধ থাকায় এ খাতেও সংকোচন হয়েছে। তবে ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারিদের থেকে মাসে ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা বিদ্যুৎ খরচ আদায় হয়।

এছাড়া বিভিন্ন দপ্তরের আপ্যায়ন, সভা-সেমিনার, পানি, ডাক, আসবাবপত্র, মনিহারী, চাকসু, চিকিৎসা, দৈনিক মজুরি, শিক্ষা উপকরণসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয়ও সংকোচন হওয়ার কথা। এই দুই মাসের অনির্ধারিত বন্ধে কোটি টাকার বেশি সংকোচন হওয়ার কথা। তবে প্রতি বছর রমজান মাসে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে।

ছাত্র কল্যাণ তহবিলের টাকা কোথায়?
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭২ জন শিক্ষক এবং দুই হাজার ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। প্রত্যেকের বেতন থেকে ছাত্র কল্যাণ তহবিলে মাসে ২৫ টাকা করে কেটে রাখা হয়। সে হিসেবে প্রতি মাসে ৭২ হাজার ৯৫০ টাকা জমা হলে, বছরে এ তহবিলে ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা থাকার কথা তহবিলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিয়ামক (ভারপ্রাপ্ত) মো. ফরিদুল আলম চৌধুরী বলছেন, ‘ছাত্র কল্যাণ তহবিলে সাধারণত টাকা জমা থাকে না। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে ও খেলাধুলায় এখান থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন মনে করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কেন্দ্র-ই শিক্ষার্থীরা। তাদের অবস্থা-ই যদি খারাপ থাকে তবে এ বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কি হবে! এই বিপদে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তব্য। এক্ষেত্রে সামর্থ্যবান অ্যালামনাইদের যুক্ত করা যেতে পারে।’

মেস ও কটেজ ভাড়ার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। প্রক্টর অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান বলেন, ‘ক্যাম্পাসের কটেজের পাশাপাশি শহরের মেসেও শিক্ষার্থীরা থাকেন। সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা যাবে না। ক্যাম্পাস খোলার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সক্ষমতা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।’

এক জবাবে তিনি বলেন, ‘ছাত্র কল্যাণ তহবিল ও চাকসুর তহবিলে টাকা আছে কিনা, তা আমার এখন জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো, যদি টাকা থাকে তবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণেই তা ব্যয় করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন