করোনা সংকটেও উদীয়মান মজবুত অর্থনীতির শীর্ষ দশে বাংলাদেশ

শক্তির উৎস চিহ্নিতপূর্বক অর্থনৈতিক পুনরুত্থান সহায়ক নীতি-পরিকল্পনা নেয়া হোক

দি ইকোনমিস্টের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায়ও ভারত-চীন কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বাংলাদেশের অর্থনীতি। সেই হিসাবে বাংলাদেশের অনেক পেছনে রয়েছে পাকিস্তান। তারা বলছে, নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী পরিস্থিতিতেও ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে নবম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। চারটি সম্ভাব্য দিক বিবেচনা করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হলো জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারি ঋণ, বৈদেশিক ঋণ, ঋণের সুদ রিজার্ভ। ওই তালিকা অনুযায়ী, সবগুলো সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশ শক্তিশালী বা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। একথা সত্য, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। কয়েক মাসের আমদানি বিল পরিশোধে সক্ষমতা রয়েছে এখন। এপ্রিলেও রেমিট্যান্সপ্রবাহ ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিই স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, তার একটি বড় অংশ প্রবাসী। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেশে ফেরত নেয়ার তাগাদা দিচ্ছে। এতে আগামীতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে জনশক্তি রফতানি বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জিডিপির শতাংশ হিসাবে সরকারি ঋণ এখনো সহনীয় সীমার মধ্যে রয়েছে। বৈদেশিক ঋণ জিডিপি অনুপাতও আশার আলো দেখাচ্ছে। তাছাড়া গত কয়েক বছর ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সম্ভাবনাময় উদীয়মান অর্থনীতির একটি দেশ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। এসবই আশার কথা। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হলে চলবে না। দেশের অর্থনীতিকে করোনা-পরবর্তী চাঙ্গা করতে এখনই অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে।

২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। কিন্তু ভাইরাসের কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা এই অর্জনকে দুরূহ করে তুলতে পারে। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী দেশ নেপালও কয়েক বছর আগে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ভূমিকম্পের কারণে তাদের অর্থনীতিতে যে ভঙ্গুরতার সৃষ্টি হয়, সে কারণে তারা চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশের অবস্থাও তেমন হতে পারে। করোনা-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি করবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারা। বাংলাদেশ এমনিতেই উচ্চ বেকার সমস্যার একটি দেশ। সংক্রমণের কারণে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন উৎপাদন যন্ত্র বন্ধ থাকার কারণে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে ওঠার জন্য প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানাগুলো ব্যাপক ভিত্তিতে শ্রমিক ছাঁটাই করতে পারে। নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও কমে আসবে। আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে যা কিছুই ঘটুক, বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার খুব সহসা আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একইভাবে আমাদের প্রধান বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক বাস্তবতা আগে থেকেই সংকটাপন্ন। সেই সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকা থেকেও হাজার হাজার বাংলাদেশী নাগরিক প্রতি মাসে শত শত মিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছে। করোনা মহামারীতে সেসব দেশে কোটি কোটি মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর কথাও শোনা যাচ্ছে।

স্বল্পমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ খাত স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য সহায়তা প্রণোদনার যেমন কোনো বিকল্প নেই, মধ্যম দীর্ঘমেয়াদে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে এখন থেকেই। প্রথমত, স্বাস্থ্য খাতকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ এখন আর নেই; স্বল্পোন্নত দেশগুলোও যখন তাদের জাতীয় আয়ের শতাংশেরও বেশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে তখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হার শতাংশেরও কম। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন, ব্যক্তি খাতের সেবার মানের পরিবীক্ষণসহ প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়াতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে  সরকারের জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম (এনএসএসএস) অতি দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। নীতিমালার আওতায় কমসংখ্যক কার্যক্রমের মাধ্যমে সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান সামাজিক বীমা কর্মসূচিকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, যা কিনা বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি। শিক্ষা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।

সামষ্টিক অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বড় আঘাত আসার সম্ভাবনা তৈরি পোশাকসহ রফতানি খাত আর রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপর। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত তহবিল যাতে শ্রমিকদের বেতন কল্যাণ বাবদ ব্যয় হয়, সে বিষয়ে নিবিড় পরিবীক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয় রফতানি খাতের বহুমুখীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা, তাই পরবর্তী বাজেটে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ শিল্পসহ নতুন শিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রণোদনার ব্যাপারে নীতি সহায়তা বাঞ্ছনীয়। রফতানিমুখী বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি ২০২০-২১ সালের বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের দিকে। স্বল্পমেয়াদে প্রণোদনা ছাড়াও স্বল্প সুদে ঋণ, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ, কাঁচামালের ওপর শুল্ক মওকুফের মতো নীতি সহায়তার মাধ্যমে এসব ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাকে সহায়তা দেয়া যেতে পারে। আশার কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা কাঠামোয় বিষয়ে বিশেষ প্যাকেজের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যা ধরনের শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের জন্য সহায়ক হবে। শিল্প আর সেবা খাত ছাড়াও কৃষির উৎপাদন ধরে রাখতে কৃষকদের বিশেষ সহায়তা প্রদান জরুরি। তাদের উৎপাদিত পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ৮৫ শতাংশ শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যাপারে। রিকশাচালক, গৃহসহায়িকা, মুদি দোকানদার, ক্ষুদ্র ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীসহ বিশাল এক জনগোষ্ঠী অন্তত সাময়িকভাবে কাজ হারাতে পারে, যাদের সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে দ্রুত আনা প্রয়োজন। এছাড়া শহরের বস্তিগুলোয় নিয়মিতভাবে বিনা মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ, বাড়ি ভাড়া মওকুফ ছাড়াও স্বল্পমূল্যে বড় পরিধিতে রেশন ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে বর্তমানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছাড়াও দারিদ্র্যসীমার ওপরের নভেল করোনাভাইরাস-পূর্ববর্তী সময়ে দরিদ্র নয়, এমন জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ সংক্রমণ-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ত্রাণ দুর্যোগ, সামাজিক সুরক্ষা, শিল্প আর স্বাস্থ্য খাতের এই অতিরিক্ত ব্যয় বহনের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ অর্থের। উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহায়তার বাইরেও দরকার হবে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বাড়ানো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন