দুই বছরের কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে আরেক দফা বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম।
এবার পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন—তিন ক্ষেত্রেই দাম বাড়ানো হয়েছে।
ঘোষিত মূল্যহার অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, পাইকারিতে প্রতি ইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ আর সঞ্চালনে প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা করা হয়েছে।
ফলে গ্রাহকদের প্রতি মাসে গুনতে হবে বাড়তি টাকা।
নতুন এ হার মার্চ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।
এবার বিদ্যুতের দাম এমন এক সময়ে বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে, যখন দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্র কিছুটা নিষ্প্রভ।
শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের আঘাত বিরাজমান।
ফলে উৎপাদন খাতের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির।
এক
হিসাবে দেখা গেছে, একটি কারখানার মোট খরচের ৩০-৪০ শতাংশই খরচ হয় বিদ্যুতে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান মন্দাবস্থায় নতুন হার কার্যকর হলে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী মহলের জন্য তা হবে ‘মড়ার
উপর খাঁড়ার ঘা’
দশা। স্বভাবতই
বিদ্যুতের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যার বড় অভিঘাত পড়বে বাজারে।
এদিকে এমনিতে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী।
কাগজ-কলমে নিয়ন্ত্রণে আছে বলা হলেও বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হারও কিছুটা বাড়ছে । দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে ত্রাহি অবস্থা সাধারণ ভোক্তাদের।
এর
ওপর সামনে রোজা।
অতীত অভিজ্ঞতা বলে, রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে কয়েক গুণ।
সরকারের তদারকিজনিত বাজার ব্যর্থতার কারণে এবারো এর ব্যতিক্রম আশা করা কঠিন।
কাজেই রোজার আগে আগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত একটি সিদ্ধান্ত।
এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তেমনি সর্বসাধারণের দুর্ভোগও বাড়বে বৈকি।
তাই আলোচ্য সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা জরুরি।
এদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে আমদানি করা কয়লার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা, গ্যাসের ওপর ডিমান্ড চার্জ আরোপ, অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোয় ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বৃদ্ধির কথা।
এসব কারণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
কেননা বিদ্যুৎ খাতের অযৌক্তিক ব্যয় না কমিয়ে বরং জনসাধারণের ওপর ব্যয়ভার চাপানোর নীতি নেয়া হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন না থাকলেও সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ দেয়া হচ্ছে।
ফলে ঘাটতি বাড়ছে পিডিবির।
আবার সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিপিসির দেয়া তেলে চলতে পারলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো নিজেরা পৃথকভাবে তেল আমদানি করে।
এতে অনেক বাড়তি খরচ হয়।
এসব ব্যয় বিদ্যুতের উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেয়।
আর
এর
মাশুল গুনতে হয় সর্বসাধারণকে।
তদুপরি আছে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অভিযোগ।
রয়েছে তথাকথিত সিস্টেম লস।
বিশেষজ্ঞদের মত হলো, বিদ্যুৎ খাতে অদক্ষতা ও অনিয়ম কমানো গেলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না।
সুতরাং সময় এসেছে এ খাতেও দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অভিযান পরিচালনার।
এটা সত্যিই প্রশংসনীয় যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তবে বিদ্যুৎ খাতে তুলনামূলক সাশ্রয়ী পথে না হেঁটে সরকার ব্যয়বহুল পথে হাঁটার নীতি নিয়েছে। সরকারি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার না করে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে বেশি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কয়েক দফা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে যা বড় প্রভাবক ভূমিকা রাখছে। স্বল্প ও যৌক্তিক মূল্যে মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে হলে বিদ্যমান নীতি পর্যালোচনার দাবি রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদ্যুৎ তথা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর শেষ পর্যন্ত তা বহন করতে হয় ভোক্তা সাধারণকে। তাই সাধারণ ভোক্তাদের সামর্থ্য তথা জনস্বার্থ বিবেচনায় বিদ্যুতের দাম কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, তা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। বিদ্যুতের মতো জরুরি প্রয়োজনীয় সেবা খাতে জনবান্ধব নীতি নিয়ে এগোনোই একটি গণতান্ত্রিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিষয়টি আমলে নিয়ে নীতিনির্ধারক মহল সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ নেবে—এটিই প্রত্যাশা।