কেবল নামেই শাসন করছিলেন সম্রাট

১৮৫৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখা দেয় সিপাহি বিদ্রোহের চেহারায়। যার ধারাবাহিকতায় অবসান ঘটে কোম্পানি শাসনের। শুরু হয় ব্রিটিশরাজ। নিভে যায় মোগলদের শাসনপ্রদীপ। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্নেহধন্য কবি জহির দেহলভির ওই সময়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থকে ইংরেজিতেদাস্তান--গদর: দ্য টেল অব দ্য মিউটিনিনামে প্রকাশ করেছে পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউজ ইন্ডিয়া। সিপাহি বিদ্রোহের অমূল্য দলিলটিকে বাংলায় প্রকাশের স্বত্ব পেয়েছে বণিক বার্তা। শানজিদ অর্ণবের রূপান্তরে ধারাবাহিক আয়োজন

আসন্ন ধ্বংসযজ্ঞের বার্তা

চার মাস পর এক বিরাট বিদ্রোহ আমাদের মাথায় ভেঙে পড়েছিল। ব্রিটিশরা আমাদের সব সহায়-সম্বল নিয়ে গিয়েছিল। একটা আংটিও অবশিষ্ট ছিল না। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া সম্পদ ছাড়াও ব্রিটিশ সেনারা আমাদের ঘরের জিনিসপত্রও লুটপাট করেছিল, যার মূল্য ৪০ হাজার রুপির বেশি। শাহজাহানাবাদ ত্যাগ করার সময় তারা লুটপাট চালিয়েছিল। তারা এমনসব অমূল্য জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিল, যা আর কখনই পাওয়া সম্ভব নয়। তারা আমার পূর্বপুরুষদের হাতে লেখা পবিত্র কোরআন--মাজিদের ২০টি কপি লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে সাতটি কপি ছিল আমার পিতার হাতে লেখা। আমাদের বাড়িতে থাকা অমূল্য সব বই লুট হয়ে গিয়েছিল, ধ্বংস করা হয়েছিল। এসব বইয়ের মধ্যে ছিল তারিখ--রাওজাত আল-সাফা, তারিখ--ফিরিশতা শাহনামা। এসব বই ৩০০ রুপি দিয়ে আমার জন্য বাবা কিনে এনেছিলেন।

আমার বিয়ের এক মাস পরই আমার ছোট বোনের বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়। আমার স্ত্রীর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। একটা মাস ছোট বোনের বিয়ের আয়োজন আর দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটাতেই চলে গেল। 

আমার বিয়ের পরই রমজান মাস শুরু হয়েছিল। তাই সে সময় বিয়ে উপভোগ করার সুযোগ আমার হয়নি। রমজান মাসের সপ্তম দিনে আমি আমার ছোট ভাই ইফতারের কয়েক ঘণ্টা আগে জামা মসজিদের উদ্দেশে রওনা হই। ফেরার সময় আমরা বুঝতে পারলাম, বাড়িতে গিয়ে ইফতার করার সময় আর অবশিষ্ট নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দুই ভাই মিলে মাতিয়া মহলে ইফতার করব। আমি শ্বশুরবাড়িতে হাজির হলাম, সেখানে আমার উপস্থিতি ঘোষণা করা হলো। একজন পরিচারক এগিয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলে উঠল, ‘মিয়া, আপনি ভেতরে আসছেন না কেন? এখানে এমন কেউ নেই, যাকে আপনার সামনে পর্দা করতে হবে। আপনার শাশুড়ি ব্যতীত বাড়িতে আর কোনো স্ত্রীলোক নেই। পুরো পরিবার গেছে বাদি বেগম সাহেবার সঙ্গে বকশিজির বিয়ের আনুষ্ঠানে। শুধু নওয়াব সাহেব আমার ভাবো এখানে আছেন।

জবাবে আমি বললাম, ‘আমার ছোট ভাইও সঙ্গে আছে। দয়া করে পর্দার ব্যবস্থা করুন।

পরিচারক ভেতরে গিয়ে পর্দা টানিয়ে দরকারি ব্যবস্থা করল। ঘরের বাইরে কাঠের তৈরি একটা পাটাতন ছিল। এখানে আমার শ্বশুর বসতেন। আমি আমার ছোট ভাই গিয়ে তাকে সালাম দিলাম।

তিনি বললেন, ‘আহ! আমার সন্তানরা, বসো।

আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে রোজা ভাঙার বার্তা ঘোষিত হলো কামানের গোলার ধ্বনিতে। রোজা ভেঙে আমরা নামাজ আদায় করলাম। টেবিল পাতা হলো, আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। কয়েক লোকমা মুখে দেয়ার পরই আমার শ্বশুর বললেন, ‘নওয়াব মির্জা, মনে হচ্ছে শহরে সহিংসতা রক্তপাত ঘটতে যাচ্ছে।

আমি জবাবে বললাম, ‘আপনি আমার বুজুর্গ, কিন্তু তার পরও জিজ্ঞেস করি, কী লক্ষণ দেখে আপনার এমনটা মনে হচ্ছে?’

নওয়াব সাহেব বললেন, ‘পুত্র, আমার আশঙ্কার বিপরীত কোনো তথ্য কি তোমার কাছে আছে? আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, শিগগিরই শহরে রক্তপাত শুরু হবে।

আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম এবং তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাশিয়া থেকে কি কোনো সেনাবাহিনী আসবে?’

একমাত্র আল্লাহই সব জানেন’—তিনি জবাব দিলেন।

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার মনে হয় কখন এসব ঘটা শুরু হবে?’

নওয়াব সাহেব বললেন, ‘মানুষজন বলছে, যা- ঘটুক না কেন, সেটা রমজান মাসেই ঘটবে এবং তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, আমিও শহীদ হব।

আমি বললাম, ‘খোদার ওয়াস্তে এমন কথা বলবেন না। আল্লাহ আপনাকে নিরাপদে রাখুন। আপনি আমাদের গুরুজন।

খোদার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে না।

আমরা রাতের খাবার শেষ করে পান খেয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

মোগল সাম্রাজ্যের অবস্থা

যেখানেই খুঁড়বে, দেখবে ভিত্তিপ্রস্তরগুলো উন্মুক্ত হয়ে আছে

মানুষের সম্পদ বাড়লেও তাদের বাড়িগুলো খালি পড়ে আছে

মোগল সাম্রাজ্যের যেদিকেই তাকাবেন, দেখবেন তার ভিত্তিগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে, একেবারে ভগ্নদশায় পতিত হয়েছে। জনবহুল এলাকাগুলোতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির আধিক্য দুর্দশার চিত্রটি প্রকট আকারে প্রকাশ করছিল।

অতএব হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।

(সূরা আল-হাশ্র: )

তিমুরীয় বংশের গৌরবোজ্জ্বল সাম্রাজ্য বাস্তবে এখন থেকে ১৫০ বছর আগেই পথচ্যুত হতে শুরু করেছিল। উত্তরসূরিরা নিজেদেরই ধোঁকা দিচ্ছিল এই বলে যে:

এখানেই তোমার এবং আমার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলো

(সূরা আল-কাহাফ: ৭৮)

সম্রাট কেবল নামেই শাসন করছেন। হিন্দুস্তানের সবচেয়ে ছোট রাজার সমান ক্ষমতাও তার আর নেই। কবি সাউদা যেমনটা বলেছেন:

একজনের অধীনে আছে বাইশটি প্রদেশ

অথচ সৈনিককে একমুঠো খাবার দেয়ার আয় তার নেই

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাটকে মাসে এক লাখ রুপির সামান্য ভাতা দিত। এর বাইরে তিনি সাম্রাজ্যের নামে থাকা জমির খাজনা পেতেন। শাহজাহানাবাদের বাড়িঘর থেকেও জমির রাজস্ব পেতেন। সব মিলিয়ে মাসে তার আয় ছিল সোয়া লাখ রুপি। একমাত্র সম্রাটের দরবারের জাঁকজমক, মর্যাদা, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য, দরবারের আয়োজন দেখেই কেবল কেউ অনুমান করতে পারতেন যে, পরিবার একসময় হিন্দুস্তানের সার্বভৌম শাসক ছিল। জাল্লা জালালুহু! (তার গৌরব আরো মহিমান্বিত হোক!)

সম্রাটের মর্যাদা কর্তৃত্ব খর্ব হওয়া, আর্থিক সংকট সম্পদহানি সত্ত্বেও দুটো বিষয় আমাকে বিস্মিত করেছিল ঝটকা দিয়েছিল। এমনকি এখনো সেগুলোর কথা ভেবে বিস্মিত হই।

প্রথমত, আল্লাহর অশেষ রহমতে, সম্রাট ওই এক লাখ রুপি এত দক্ষভাবে খরচ করতেন যে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় এমন দরবারেও এমন জাঁকজমক দেখা যেত না। যে সৈন্য চার রুপি আয় করত এবং যার অঢেল সম্পদ ছিল, তারা উভয়ই একই রকম সুখী ছিল। ভাগ্যের দুর্দশাকে কেউ অভিশাপ দিত না। এটা ছিল মনের শক্তির বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয়ত, সম্রাটের দরবারে যে রাজকীয়তা জাঁকজমক দেখা যেত, তা অন্য কোনো রাজ্যে দেখা যেত না।

কেউ যদি দরবারের আয় খরচের দিকে দৃষ্টি দেন, তাহলে যে কেউ অবাক হয়ে ভাবতেন, দুয়ের মধ্যে সংশ্লিষ্টরা সমন্বয় করেন কীভাবে! অর্জিত রাজস্বে কী কোনো আশীর্বাদ আছে যে দরবারের ব্যয় মেটাতে কখনো অর্থের সংকট হয় না? খরচের খাতগুলোর মধ্যে ছিল: রাজকীয় কারখানা, সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, জল বিভাগ, ঔষধালয়, রাজকীয় পোশাক বিভাগ, রাজকীয় অলংকার বিভাগ, গোলন্দাজ বিভাগ, উটের খামার, যানবাহন, ছাতা তৈরির কারখানা, রাজকীয় মত্স্য প্রতীকের আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা, কোয়ার্টারমাস্টারের দপ্তর, গ্রন্থাগার, কবুতর পালন, অতিথিদের কর্তৃক সম্রাটকে দেয়া নজরানার হিসাব রাখা কর্মীদের বেতন, কার্পেট/আসবাব বিভাগের কর্মচারীদের বেতন, ঘোড়ার গাড়ির দায়িত্বে থাকা কর্মচারী গাড়ির কুলিদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীর বেতন, রাজকীয় দেহরক্ষীদের দপ্তর, খোজাদের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা, সাজা দেয়ার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা গৃহস্থালি খরচের বিভাগ।

সবার কথা বিস্তারিতভাবে এখানে উল্লেখ করা অসম্ভব। কারণ তালিকাটা আরো অনেক দীর্ঘ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন