ভূমি ব্যবস্থাপনা

এগোয় না অটোমেশন কমে না ভোগান্তি

তবিবুর রহমান

রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা হারুন আহমেদ। উত্তরা জসীমউদ্দীন সড়কের ভূমি অফিসে এসেছিলেন জমির নামজারি করতে। এর আগে অনলাইনে নামজারির আবেদন করেছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে কাগজপত্র নিয়ে ভূমি অফিসে আসেন তিনি। সেখানে জানা গেল, আবেদনে কিছু ভুল ছিল। তাই নতুন করে আবেদন করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাজার ১৫০ টাকা জমা দিয়ে আবারো আবেদন করেন তিনি। এরপর নিয়ম অনুযায়ী সাতদিনের মধ্যে নামজারি হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় মাস ঘুরেও তা করতে পারেননি হারুন আহমেদ। সময় ভূমি কর্মকর্তাদের কাছে ফাইল নিয়ে গেলে বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন তা। উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার টাকা বকশিশ দিয়ে নামজারি করান তিনি।

তিনি জানালেন, শুধু নামজারি না, জমির খাজনা পরিশোধ করতেও প্রতি বছর অতিরিক্ত হাজার টাকা বকশিশ দিতে হয় এখানে।

সরকার জমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নিয়েছিল জটিলতা নিরসন এবং দুর্ভোগ হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে। এজন্য পাইলট ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আলাদা আলাদা প্রকল্পও নেয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকটি পুরোপুরি বাস্তবায়নও হয়েছে। যদিও এগুলোর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাননি গ্রাহকরা।

অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, সার্ভার জটিলতাসহ মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনাগ্রহে মুখ থুবড়ে পড়েছে এসব কার্যক্রম। ফলে প্রকল্পের সুফল যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনি লাঘব হয়নি সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তিও।

জমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে ডিজিটাল করার উদ্দেশ্যে বর্তমানে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের আওতায় অনলাইনে কিছু সেবা দিচ্ছে ভূমি অধিদপ্তর। যদিও সেবাকে পুরোপুরি ডিজিটাল করা যায়নি এখনো। অনলাইনে আবেদন করা গেলেও সেবা নিতে যেতে হয় ভূমি অফিসে। ফলে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমছে না, অন্যদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনার অধিকাংশ কাজই চলছে সনাতন পদ্ধতিতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অটোমেশন সেবা নিশ্চিতের জন্য -তথ্য ব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনবল সার্বক্ষণিক সেবা চালু রাখার জন্য যে ধরনের আইটি সেবা দেয়া প্রয়োজন, তা একটি সক্রিয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানো জটিল হবে। গত ৩০ বছরে খাতে অটোমেশন সেবা নিশ্চিতে সরকার বিভিন্ন পাইলট প্রকল্প নিলেও তার কোনোটারই সুফল পায়নি সাধারণ মানুষ।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) সহায়তায় যশোরের মণিরামপুর, পটুয়াখালীর কলাপাড়া নরসিংদী সদর উপজেলার ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করতে (আইডিএলআরএফ) একটি পাইলট প্রকল্প নেয়া হয়। এর কাজ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এটি বাস্তবায়নের পর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল তৈরি হবে, যার এক কপি অনলাইনে চলে যাবে জেলা ভূমি অফিসে। এরপর জেলা ভূমি অফিস আবার ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে এসএমএসের মাধ্যমে নোটিস পাঠাবে।

শুরুতে নিয়ম মেনেই চলছিল কার্যক্রম। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সাব-রেজিস্ট্র্রার অফিস থেকে অনলাইনে জেলা ভূমি অফিসে কপি পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। আবার জেলা ভূমি অফিসেও কাজে ব্যবহূত সার্ভার কিছুদিনের মধ্যেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে প্রকল্প খুব একটা কাজে আসেনি।

তথ্য বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এখন পর্যন্ত অনলাইনে দলিলের কপি গেছে মাত্র ১৩৭টি। বাকি প্রায় আড়াই হাজার কপি গেছে হাতে হাতে।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার সাভার উপজেলার পাঁচটি মৌজায় পরীক্ষামূলকভাবে অনলাইনে ভূমি ব্যবস্থাপনার কর্মসূচি শুরু হয়। স্থানীয়রা এখান থেকে খুব একটা উপকৃত হননি।

নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ৪৮টি মৌজায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালের অক্টোবরে। এখানেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পৌঁছেনি জনসাধারণের কাছে। ফলে জনসাধারণের সুবিধার জন্য নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত এসব প্রকল্পের ব্যয় পর্যবসিত হয়েছে স্রেফ অপচয়ে। কমেনি ভোগান্তিও।

অভিযোগ রয়েছে, মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট ভূমি কর্মকর্তারা এসব প্রকল্প যথাযথ বাস্তবায়নে আগ্রহী নন। ফলে অনলাইন থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না সেবাগ্রহীতারা। বাধ্য হয়েই তাদের আসতে হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রার বা ভূমি অফিসে। এর সুযোগে দালালদের যোগসাজশে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করছেন কিছু কর্মকর্তা।

বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার দাস বণিক বার্তাকে বলেন, জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধ এড়াতে এরই মধ্যে অনলাইনে খতিয়ান সরবরাহ, -নামজারি -সেটলমেন্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সাড়ে চার কোটি খতিয়ানের মধ্যে চার কোটি এরই মধ্যে অনলাইনে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৫০ লাখ খতিয়ান অনলাইনে দেয়া হবে। ফলে ২০২১ সালের মধ্যে অনলাইন থেকে খতিয়ান নেয়া যাবে। তবে এক ছাদের নিচে ভূমি ব্যবস্থাপনার সব সেবা অটোমেশন প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করা জটিল বিষয়।

অন্যদিকে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল করার বিষয়টি বর্তমান সরকারের একটি অঙ্গীকার। অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। এজন্য কাজকর্ম চলছে। নেয়া হয়েছে একাধিক প্রকল্প। সেগুলো পর্যায়ক্রমে বিবেচনায় নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কাজটি যতই চ্যালেঞ্জিং হোক, সরকার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন