সিনেমাকেও হার মানানো আমেরিকান ‘লবস্টার বয়’

বণিক বার্তা অনলাইন

১৯৩৭ সালের ২৬ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের পিটসবার্গ শহর। গ্র্যাডি এফ স্টাইলস সিনিয়র ও এডনার ঘর আলো করে আসে গ্র্যাডি স্টাইলস জুনিয়র। অন্য কোনো পরিবারের বেলায় হয়ত বিকৃত শারীরিক গঠনের এই শিশুকে স্বাগত জানানো হতো মুখ অন্ধকার করে বিষণ্ন বদনে। কিন্তু স্টাইলস পরিবারে এমন শিশু নতুন নয়। গ্র্যাডি জুনিয়র ছিল এ বংশে ‘একট্রোডাক্টাইলি’ রোগে আক্রান্ত চতুর্থ ব্যক্তি। বলতে গেলে এ অস্বাভাবিকতাটিই তাদের আয় রোজগারের পুঁজি ছিল।

‘একট্রোডাক্টাইলি’ একটি জিনগত অসুখ। এ রোগে আক্রান্তরা জোড়া লাগানো বাঁকা আঙ্গুল নিয়ে জন্মায়। হাত দেখলে মনে হয় যেন চিংড়ির সামনের সাঁড়াশিযুক্ত পা।

এই ‘অভিশাপকেই’ আশীর্বাদে পরিণত করেছিল স্টাইলস পরিবার। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের হাত পায়ের আঙুল বিকৃত ছিল। সেই অদ্ভুতদর্শনকেই হাতিয়ার করে সার্কাসে খেলা দেখাতেন তারা। জিনগত অসুখই হয়ে গিয়েছিল অর্থ উপার্জনের উপায়। ক্রমে এই পরিবার একটা গোটা ফ্রিক সার্কাস-শো হয়ে দাঁড়াল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে তাদের কার্নিভ্যাল মার্কিন শহরগুলোতে খুব জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু গ্র্যাডি স্টাইলস জুনিয়র থেকে বদলে গেল এই পরিবারের ইতিহাস।

গ্র্যাডি বড় হতে লাগল আর পরিবর্তিত হতে থাকল তার শারীরিক গঠন।। ততদিনে তার বাবার খেলা দেখানোর মজাদার শো খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘একট্রোডাক্টাইলি’ আক্রান্ত সন্তানদেরও তিনি এক এক করে নিয়ে নিচ্ছেন নিজের দলে। তারাও শো-এর অংশ। সাত বছর বয়সে গ্র্যাডিও যোগ দিল শোতে। হাতের সঙ্গে গ্র্যাডির পায়ের আঙুলগুলোও ছিল বিকৃত। ফলে জীবনের বেশিরভাগ অংশ তার কেটেছিল হুইলচেয়ারেই। কিন্তু তার দেহে ছিল অসুরের মতো শক্তি। সার্কাসের খেলা দেখানোও আয়ত্ত করেছিল সে। তার নাম হয়ে গিয়েছিলে ‘লবস্টার বয়’।

সার্কাস দেখিয়ে স্টাইলস পরিবারের আয় উপার্জন মন্দ হতো না। শীতকালে সার্কাস শোগুলো বন্ধ থাকতো। এ মৌসুমে অন্য পারফরমারদের সঙ্গে পুরো পরিবার থাকতো ফ্লোরিডার গিবসনটনে। সার্কাসের মৌসুমে, তখনকার দিনে তাদের উপার্জন ছিল প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ডলার। এর মধ্যে একদিন স্টাইলসদের সার্কাস দলে যোগ দিল মারিয়া টেরেসা নামে এক কিশোরী। আরেক সূত্রে তার নাম মে টেরেসা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এই কিশোরী যোগ দিয়েছিল সার্কাস দলে। সে কোনো খেলা দেখাতো না, অন্য কর্মীদের মতো কাজ করতো। মারিয়ার প্রেমে পড়েন গ্র্যাডি। দু’জনে বিয়েও করেন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ক্যাথি ছিল একেবারে সুস্থ। এই মেয়ে ছিল বাবার খুব আদরের।


কিন্তু দায়িত্ববান বাবা হওয়ার বদলে স্টাইলস ক্রমশ বেপরোয়া মদ্যপায়ী হয়ে উঠলেন। নেশার ঘোরে স্ত্রীর উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতেন। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। গ্র্যাডি মেনে নিতে পারেননি তার কিশোরী কন্যার প্রেমের সম্পর্কও। ১৯৮৮ সালে পিটসবার্গে বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় ঠান্ডা মাথায় নিজের শটগান দিয়ে মেয়ের হবু স্বামীকে খুন করেন গ্র্যাডি।

প্রথমে পুলিশ এবং পরে আদালত, দুই জায়গাতেই অপরাধ স্বীকার করেন গ্র্যাডি। তবে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য কারাবাস থেকে রেহাই পান। কারণ একট্রোড্যাক্টিলি আক্রান্ত বন্দিকে রাখার মতো ব্যবস্থা কোনো মার্কিন কারাগারে তখন ছিল না।

পরিবর্তে গ্র্যাডির শাস্তি হয় পনেরো বছরের জন্য গৃহবন্দি থাকার। এসময় মদ্যপান ছেড়ে দেন তিনি। গ্র্যাডির সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে মারিয়াও বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে মারিয়া আবার ফিরে আসেন প্রথম স্বামীর কাছে। কিন্তু কিছুদিন পরই গ্র্যাডির মদ্যপান ও অপরাধপ্রবণতা আরো তীব্র আকার ধারণ করে। একবার কারাদণ্ড এড়িয়ে তার মনে হয়েছিল, সে এখন আইনেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। 

স্ত্রী এবং সন্তানদের ওপর গ্র্যাডির অত্যাচারের মাত্রা আগের থেকেও বেড়ে গিয়েছিল। ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছিল ঘরের পরিবেশ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় মারিয়ার। ১৯৯২ সালে তিনি সার্কাসের ১৭ বছর বয়সী সাইড পারফরমার ক্রিস ওয়্যান্টকে দেড় হাজার ডলারে ভাড়া করেন গ্র্যাডিকে খুন করার জন্য। এই হত্যার ষড়যন্ত্রে সামিল ছিল মারিয়ার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান হ্যারি গ্লেনও।

রাতের অন্ধকারে গ্র্যাডিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে খুন করেন ওয়্যান্ট। তিন জনের কেউই তাদের অপরাধ গোপন করেননি। আদালতের রায়ে ওয়্যান্টের ২৭ বছর, মারিয়ার ৪৩ বছর ও গ্লেনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।   

অন্যদিকে, গ্র্যাডি তার পরিবারের মতো সমাজে আরো বেশি ‘ঘৃণিত’ বলে চিহ্নিত হন। বিতৃষ্ণার মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল, শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময় ‘লবস্টার বয়’-এর কফিনবহনের জন্যও পরিচিত কেউ রাজি হননি।


দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাবেক কলাম লেখক ফ্রেড রোজেন গ্র্যাডির জীবনি নিয়ে লেখেন ‘লবস্টার বয়: দ্য বিজ্যার অ্যান্ড ব্রুটাল ডেথ অব গ্র্যাডি স্টাইলস জুনিয়র’। মার্কিন ক্যাবল টিভি কোম্পানি ই! ‘ট্রু হলিউড স্টোরি’ প্রোগ্রামের একটি এপিসোডের নাম দেয় ‘দ্য মার্ডার অব লবস্টার বয়’। এ এপিসোডে গ্র্যাডির জীবন দেখানো হয়। অস্ট্রেলিয়ার রক ব্যান্ড সিলভার চেয়ারের ‘ফ্রিক শো’ অ্যালবাম কভারে গ্র্যাডির ছবি ব্যবহার করলে তার ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ফিরে আসে।  

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা ও উইকিপিডিয়া

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন