স্বাস্থ্যের ওপর ভালো ভাইরাসের প্রভাব

ফিচার ডেস্ক

বিজ্ঞানীরা ভাইরোমকে মাইক্রোবায়োমের বৃহত্তম, সর্বাধিক বৈচিত্র্যময় এবং সর্বাধিক গতিশীল অংশ বলে মনে করেন। আর সব অণুজীবের মধ্যেই ভাইরোম রয়েছে, যার মধ্যে ব্যাকটেরিওফেজ ভাইরাস অন্তর্ভুক্ত

মানবস্বাস্থ্যে ভালো ভাইরাসের ভূমিকা এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে রহস্যজনক। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ভাইরাস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় মাইক্রোবায়োমের একটি উপেক্ষিত অংশ ভাইরোম সম্পর্কে কিছু তথ্য উঠে এসেছে। যদিও স্বাস্থ্য রোগের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া মাইক্রোবায়োমের ভূমিকা চিকিৎসা গবেষণার শীর্ষে রয়েছে।

সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো থেকে উত্থাপিত অনেক প্রশ্নের উত্তর থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে রয়েছি। তবে একটা বিষয় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মাইক্রোবায়োম বোঝা ছাড়া আমরা আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ অণুজীব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বা সফল হতে পারব না। চিকিৎসাবিজ্ঞান যেভাবে ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্যের মধ্যে অসহনীয় জটিল মিথস্ক্রিয়াগুলো সারিয়ে তুলতে কাজ করে চলেছে, তেমনি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হিসেবে অপেক্ষা করছে ভাইরোমের ভূমিকা।

ভাইরোম

যখন আমরা মাইক্রোবায়োম শব্দটি শুনি, তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের ব্যাকটেরিয়ার কথা মাথায় আসে। তবে প্রযুক্তিগতভাবে মাইক্রোবায়োম হলো একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের সব অণুজীবের সমষ্টি। কয়েকজন বিজ্ঞানী অণুজীবের জিনগত উপাদানের সমষ্টি বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করেন। সুতরাং ব্যাকটেরিয়া বাদে মাইক্রোবায়োমের মধ্যে অন্যান্য অণুজীবের সঙ্গে ভাইরাস (ভিরোম) ছত্রাক অন্তর্ভুক্ত থাকে। আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ভাইরোম বা মাইক্রোবায়োমের প্রতি তুলনামূলক কম মনোযোগ দিয়েছেন।

ভাইরাসগুলো মানুষের দেহের পরিবেশগত স্থান বিশেষত নাক মুখের অভ্যন্তর এবং অন্ত্রে নিজেকে তৈরি করেছে। আর এটা স্মলপক্স, হেপাটাইটিস, এইচআইভি জলাতঙ্ক রোগের জন্য দায়ী।

ব্যাকটেরিওফেজ

বিজ্ঞানীরা ভাইরোমকে মাইক্রোবায়োমের বৃহত্তম, সর্বাধিক বৈচিত্র্যময় এবং সর্বাধিক গতিশীল অংশ বলে মনে করেন। আর সব অণুজীবের মধ্যে ভাইরোম রয়েছে, যার মধ্যে ব্যাকটেরিওফেজ ভাইরাস অন্তর্ভুক্ত। আমাদের অন্ত্রের বেশির ভাগ ভাইরাসই ব্যাকটেরিওফেজ। যেখানে ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, সেখানে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিওফেজ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীবন্ত রূপ ফেজ। কিছু সুপেয় জলের উৎসে এগুলোর প্রতি মিলিলিটারে ১০ বিলিয়নের বেশি উপস্থিতি থাকতে পারে।

ব্যাকটেরিওফেজগুলো ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমিত করে, কোষের যন্ত্রপাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং জিনগত উপাদানগুলোর প্রতিলিপি তৈরি করতে তাদের ব্যবহার করে। এখন এটি স্পষ্ট যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্য রোগকে প্রভাবিত করে, তাই এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত ভাইরাসগুলোও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

ফেজ থেরাপি

১৯২০ থেকে ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিওফেজগুলোকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহার নিয়ে অনুসন্ধান করেছিলেন। সর্বোপরি ভাইরাসগুলো রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেনকে ধ্বংস করতে পারদর্শী। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, ফেজ থেরাপি কার্যকর এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত। তবে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর ফেজ থেরাপি মনোযোগের বাইরে চলে যায়। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা সহজ এবং তারা বিস্তৃত ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে পারে। বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পুনরায় ফেজ থেরাপি নিয়ে ভাবা হচ্ছে।

ফেজ থেরাপির জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো এর নির্দিষ্টতা। অ্যান্টিবায়োটিক বিস্তৃত ব্যাকটেরিয়া প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় কিন্তু আমরা জানি, শরীরে অনেক ভালো ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থাকে, বিশেষ করে অন্ত্রে। ব্যাকটেরিওফেজ নির্দিষ্ট অঞ্চলের কাঙ্ক্ষিত ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে এবং সংক্রমণটি সেরে না ওঠা পর্যন্ত প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে।

জীবনের জন্য বন্ধু

ব্যাকটেরিওফেজগুলো মানবযাত্রার শুরু থেকেই যুক্ত হয়ে যায়। একটি গবেষণায় নবজাতকের শরীরে ভাইরাসের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে জন্মের এক সপ্তাহের পরই চিত্র পাল্টে যায়। শিশুর মলের প্রতি গ্রামে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ভাইরাস কণা ধরা পড়ে, যার বেশির ভাগ ব্যাকটেরিওফেজ। সুতরাং ভাইরোম সত্যিই আমাদের আজীবনের বন্ধু।

সিম্বিওসিস থেকে ডাইসবিওসিস

ব্যাকটেরিওফেজগুলো যেমন ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে, তেমনি কিছু পরিস্থিতিতে এগুলো ব্যাকটেরিয়াকে উপকৃত করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে একটি জীবাণুর জন্য ব্যাকটেরিওফেজ ক্ষতিকারক নয়, এগুলো পরস্পর মিথস্ক্রিয়া করে। যেহেতু ব্যাকটেরিয়া একে অন্যের সঙ্গ জিনগত উপাদান আদান-প্রদান করতে পারে, সেহেতু জেনেটিক কোডটি পৃথক একটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও স্থানান্তরিত হতে পারে। এটাকে বলা হয় সম্প্রদায় পরিবর্তন করা, যা মাইক্রোবিয়াল ভারসাম্যতা বা ডাইসবিওসিস। প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিওফেজ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াকেও পরিবর্তন করে দিতে পারে।

ডাইসবিওসিস থেকে ডায়াগনসিস

ডাইসবিওসিস প্রদাহজনিত পেটের রোগ, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সিনড্রোম, স্থূলতা, ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল সংক্রমণ, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের সঙ্গে যুক্ত। তবে গবেষকরা ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যাকটেরিওফেজগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে অনিশ্চিত।

গবেষকরা টাইপ টু ডায়াবেটিস, স্কিজোফ্রেনিয়া, হতাশা, উদ্বেগ, পারকিনসনসহ বিভিন্ন রোগের সময় অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার আশ্চর্যজনক পরিবর্তন লক্ষ করেছেন। ব্যাকটেরিওফেজ সম্প্রদায়ের এমন প্রবাহ স্বাস্থ্য রোগে ভূমিকা পালন করছে কিনা, তা আগামী দিনে হয়তো পরিষ্কার হবে। পরিবর্তন রোগ সারিয়ে তুলতে না পারলেও এটা অন্য সুবিধার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে ডায়াগনসিস হিসেবে ভাইরোম ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।

ভাইরাস নিয়ে সমস্যা

ব্যাকটেরিয়া অধ্যয়ন করা সহজ নয়, আর এগুলো অবিশ্বাস্যভাবে ছোট। ব্যাকটেরিয়া সাধারণত শূন্য দশমিক থেকে ১০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর ১০ মাইক্রোমিটার হলো মিলিমিটারের ১০০ ভাগের এক ভাগ। এর তুলনায় ভাইরাসগুলো আরো ছোট হয়ে থাকে। এটা শূন্য দশমিক শূন্য থেকে শূন্য দশমিক পর্যন্ত হয়। কারণে ভাইরাস নিয়ে কাজ করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কিছুদিন আগেও ভাইরোমকে অধ্যয়ন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে ধীরে ধীরে বাধাগুলো দূরে হচ্ছে। পর্যায়েও রোগের ক্ষেত্রে ভাইরাসের ভূমিকা নিয়ে যতটা পরিষ্কার, মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ততটা স্পষ্ট নয়।

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধে যেভাবে উদ্বেগ বাড়ছে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের রহস্যময় উপাদান ব্যাকটেরিওফেজ নিয়ে আগ্রহ তত বাড়ছে। হয়তো কয়েক দশকের মধ্যে মানবজাতির সামনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে এর কার্যকারিতা। তবুও আমাদের মাইক্রোবায়োমের উপাদানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কার্যকারিতা বোঝা শক্ত হবে। এটা যে দীর্ঘ লড়াই, তা সহজেই অনুমেয়।

 

সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন