জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী

১০ বছর আগের বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বিরাট ব্যবধান

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, গত বছর সরকার গঠনের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণে আমি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শোধরানোর আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমি আবারো সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই, দুর্নীতিবাজ যে- হোক, যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের ছাড় দেয়া হবে না। বর্তমান সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদকের বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। পবিত্র ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা করে কেউ যাতে তরুণদের বিপথে পরিচালিত করতে না পারে, সেজন্য মসজিদের ইমামসহ ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সারা দেশে ৬৫০টি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি থাকবে না। সব ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। সবাই নিজ নিজ ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে সক্ষম হচ্ছে।

বিগত এক বছরে সরকার সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সর্বক্ষেত্রে শতভাগ সফল হয়েছি, তা দাবি করব না। কিন্তু এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। সবার সহযোগিতায় আমরা সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করব।

শেখ হাসিনা সময় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১০ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। দেশের মানুষ ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখা ভুলেই গিয়েছিল।  আজ তারা স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের। স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বাঁচার। প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মিত হবে আর সেই সেতু দিয়ে গাড়ি বা ট্রেনে সরাসরি পারাপার করতে পারবে, এটা ছিল মানুষের স্বপ্নেরও অতীত। আমরা সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চলেছি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। তিন ভাগের দুই ভাগেরও বেশি কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রায় অর্ধেকাংশ এখন দৃশ্যমান।

তিনি বলেন, রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাতালরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পর চন্দ্রা-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশন-রংপুর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে।

রেল যোগাযোগ উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন রেলপথ নির্মাণ, নতুন কোচ ইঞ্জিন সংযুক্তি, -টিকিটিং এবং নতুন নতুন ট্রেন চালুর ফলে রেল যোগাযোগে নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে। ২০০৯ থেকে পর্যন্ত ৪০১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ১২২টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই সেতুর ওপর দিয়ে রেল চলাচল শুরু হবে বলে আশা করছি। দেশের সব জেলাকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনা হচ্ছে।

আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিমানবহরে ছয়টি নতুন ড্রিমলাইনার যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নিজস্ব উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে গেছে। ৯৭ ভাগ মানুষ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধার আওতায় এসেছেন। টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রামপাল, মাতারবাড়ী, পায়রা মহেশখালীতে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তিনি বলেন, দেশে সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা আজ সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। উপজেলা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। স্থাপন করার হয়েছে হূদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল। অব্যাহত নার্সের চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট। বিগত ১১ বছরে ২০ হাজার ১০২ জন নতুন চিকিৎসক এবং ২১ হাজার ৬৯৭ জন নার্স  নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনের কাজ চলছে।

শিক্ষা খাতে সরকারের অবদান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত প্রতি বছর কোটি লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি, উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হচ্ছে। আমরা পর্যন্ত ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক এবং ৬৮৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কলেজ জাতীয়করণ করেছি। ২০০৯ থেকে পর্যন্ত হাজার ৬৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে।

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫ কোটিরও বেশি সিম ব্যবহূত হচ্ছে। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় কোটি। দেশের সাড়ে হাজারের বেশি ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড সংযোগ দেয়া হয়েছে। আমরা ফোর-জির পর ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালুর উদ্যোগ নিয়েছি।

সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের প্রধান লক্ষ্য তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। চলতি মেয়াদে  আমরা দেড় কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে ১৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের জন্য আসছেন।

মুজিব বর্ষ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর। বছর উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আগামী ১৭ মার্চ বর্ণাঢ্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার শুভ সূচনা হবে, আমরা এরই মধ্যে ২০২০-২১ সালকে মুজিব বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছি। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানমালা যুগপত্ভাবে চলতে থাকবে। এই উদ্যাপন শুধু আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব নয়, এই উদ্যাপনের লক্ষ্য জাতির জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন