পেঁয়াজের বিমানযাত্রা

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

সৌভাগ্যবান পেঁয়াজ তার ততোধিক ভাগ্যবান বাংলাদেশী ভোক্তাদের জন্য সুদূর মিসর থেকে নিরাপদে বিমানযোগে ঢাকা পৌঁছেছে। আশা করা যাচ্ছে কয়েক দিনের মধ্যে তা বিভিন্ন হাত ঘুরে সাশ্রয়ী মূল্যে এতদিন পেঁয়াজমুক্ত শিঙ্গাড়া, ভর্তা, ডালভোগী দুস্থ বাংলাদেশীদের হেঁশেলে পৌঁছবে। এতদিন দেশের বাইরের কেবল ভারত মিয়ানমারের পেঁয়াজ খেলেও এখন চীন, মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান, আফ্রিকার দেশ মিসর, ইউরোপের দেশ তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ইউক্রেন এবং স্লোভাকিয়া থেকেও পেঁয়াজ আসছে। ক্রেতাদের জন্য এটা বড় একটা স্বস্তির সংবাদ!

কিন্তু এরই মধ্যে মাঠ থেকে পেঁয়াজ তুলে তুলনামূলকভাবে উচ্চমূল্যে বিক্রির প্রত্যাশী চাষীর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। গত মৌসুমে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ২০ টাকায় নেমে আসায় কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগের বছরের মূল্য হ্রাসজনিত বছর বন্যার ফলে ফসলহানির ক্ষতির খানিকটা পুষিয়ে নেয়ার যে স্বপ্ন চাষী দেখেছিলেন, তা মনে হয় পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশের চাষীদের স্বপ্ন দেখতে নেই! যাই হোক, আগে পেঁয়াজের বিমানযাত্রার পেছনের কথা বলি।

 

দেশজ উৎপাদন আমদানি

দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ডিএইর ১৭ জুলাইয়ের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে এবার পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজার টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় লাখ টন বেশি। অবশ্য এখন তাদের ওয়েবসাইটে উৎপাদনের নতুন হিসাব উল্লে¬ করা হচ্ছে। সেখানে উৎপাদন দেখানো হচ্ছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। বলা হচ্ছে আমদানি করা হয়েছে ১০ লাখ টন। সংশ্লি¬ষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। সরকারি সংস্থাগুলোর উৎপাদন আমদানির পরিসংখ্যান সঠিক হলে দেশে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কথা নয়।

সংকটের শুরু হয় ১৩ সেপ্টেম্বর, যখন ভারত সরকার প্রতি টন পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রফতানি মূল্য মার্কিন ডলার ৮৫০ নির্ধারণ করে, তখন থেকেই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ হ্রাস পায়। পরবর্তীতে ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কথিত আছে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করলেও ভারত মালদ্বীপে তা রফতানি অব্যাহত রাখে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রে নির্বাচনের পর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। নিষেধাজ্ঞা আজ পর্যন্ত বলবত্ আছে। বাজারে দেশী পেঁয়াজের ফলন আসে ডিসেম্বরের শেষ জানুয়ারির শুরুতে, যা দিয়ে ছয়-সাত মাস চলে। বাকি সময়টা আমদানীকৃত পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই একদম বাড়তি চাহিদার সময়েই ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে। ফলে পেঁয়াজের দামে এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০-১৩০ টাকায় উল্ল¬ম্ফন ঘটে।

 

সরকারের প্রতিক্রিয়া কার্যক্রম

প্রথমত, সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহের ঘাটতি নেই বলা হলেও পরে শিল্পমন্ত্রী বলেন, পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আছে। মন্তব্যের পর পেঁয়াজের মূল্য আরো ৫৫ শতাংশ বেড়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ ৩৮ হাজার৬ টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বড় এবং সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেয়া হয়। মোট অনুমতির ৫৫ হাজার টনই এস আলম গ্রুপের বলে জানা গেছে। ভবিষ্যতে ধরনের বিপর্যয় এড়াতে করণীয় কী?

সঠিক পরিসংখ্যান

বলা হয়ে থাকে মিথ্যা তিন প্রকার। সাদা মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা সরকারি পরিসংখ্যান। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার তাদের সাফল্য দেখাতে গিয়ে জিডিপির হিসাব বাড়িয়ে দেখায় বলে অভিযোগ আছে। চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ কেউ এর ব্যতিক্রম নয়। এটা সাময়িকভাবে কাজ করলেও পরে তা বুমেরাং হয়ে যায়। সরকারি পরিসংখ্যান কেবল সরকারই ব্যবহার করে না। ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তারাও তাদের উৎপাদন আমদানির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য এটা ব্যবহার করে। ভারত এটা ঠেকে শিখেছে। আগে জিডিপি উপাত্ত বাড়িয়ে বলায় ব্যবসায়ীরা সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করেছেন, যা অবিক্রীত থেকে গেছে। ফলে তারা লোক ছাঁটাই শুরু করে। ভারত এখন তার জিডিপি হিসাব বাড়িয়ে বলার প্রবণতা থেকে ধীরে সরে আসছে। তাই পেঁয়াজসহ অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা অবিলম্বে পরিহার করে উৎপাদন আমদানির সঠিক উপাত্ত সরবরাহ করতে হবে।

 

প্রতিবেশী নির্ভরতা

সন্নিকট হওয়ার কারণে ভারত মিয়ানমার আমাদের পেঁয়াজ আমদানির যথার্থ উত্স। কেননা এসব উত্স থেকে পেঁয়াজের ন্যায় একটি ভারী পণ্য পরিবহনে আমদানি ব্যয় কম। তাছাড়া পচনশীল পণ্য হিসেবেও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে পেঁয়াজ আমদানির সপক্ষে যুক্তি আছে। কিন্তু বাড়তি চাহিদার সময় রফতানি বন্ধ করা ভারতের পুরনো অভ্যাস। আগে কোরবানির গরু আমদানির ক্ষেত্রেও তা- ঘটেছে। ফলে আমাদের শাপে বর হয়েছে। আমাদের খামারিরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দেশকে গবাদিপশু সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও কি তা হতে পারে না? আমাদের দেশে পেঁয়াজের একরপ্রতি উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তাই কৃষকদের গবেষণা মূল্যসহায়তা প্রদান করলে তারা উত্সাহিত হবেন। তাই পরামর্শ দেয়া হয়েছে, সরকার যদি স্থায়ীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে দেশী পেঁয়াজের মৌসুমে আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত। আমদানি নিষিদ্ধ করলে ভালো দাম পাবেন কৃষকরা। কৃষকরা একবার দাম পেলে পরের মৌসুমে উৎপাদন বাড়াবেন। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে বেশি সময় লাগবে না।

 

লাইসেন্স রাজ

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সংস্কার কর্মসূচির আওতায় লাইসেন্স রাজকে আমরা তুলে দিয়েছিলাম। আগে যেকোনো পণ্য আমদানির জন্য লাইসেন্স লাগত। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কন্ট্রোলার অব ইম্পোর্টস অ্যান্ড এক্সপোর্টস ঘিরে একটা চক্র গড়ে উঠেছিল। সরকার-ঘনিষ্ঠতা দুর্নীতির মাধ্যমে একশ্রেণীর লোক আমদানি অনুমতিপত্র বের করে তা খাতুনগঞ্জ চকবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দিত। তখন জাতীয় নিরাপত্তা সামাজিক স্বার্থে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের একটি ক্ষুদ্র তালিকা রেখে বাকি সব পণ্যের আমদানি অবাধ করা হয়। এখন পেঁয়াজ আমদানির পদ্ধতি দেখে মনে হয় লাইসেন্স রাজ আবার ফিরে আসছে। এটা অব্যাহত থাকলে সব ভোগ্যপণ্য নিয়েই কারসাজি চলতে থাকবে। কেবল দেশী পেঁয়াজ মাঠে আসার সময়টি ব্যতীত পেঁয়াজ আমদানি ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর জন্য উন্মুক্ত করা উচিত।

 

মার্কেট ইন্টেলিজেন্স

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা সরকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি উল্লে¬খযোগ্য কাজ। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিশনে তাদের প্রতিনিধিও আছে। জানি না ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার আগে আমাদের কলকাতা দিল্লি হাইকমিশনের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর সরকারকে অবগত করেছিলেন কিনা? যদি জানানো হয়, তাহলে ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? কেননা আমি স্থিরনিশ্চিত যে পেঁয়াজের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ বা রফতানি নিষিদ্ধ করার আগে ভারতে ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অনুবিভাগের কার্যক্রম, পদ্ধতি ব্যর্থতা এবং এর দায় চিহ্নিত করে এর আধুনিকীকরণ সংশ্লি¬ষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 

পেঁয়াজের বিকল্প চাইভস

চাইভস বলে পেঁয়াজের একটি বিকল্প আছে। অনেকে এটি বাসাবাড়ির ছাদে উৎপাদন করেন। তাই চাইভসের উৎপাদন বিপণন সম্ভাবনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার পরামর্শের বিকল্প হতে পারে এটি।  

এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পেঁয়াজকে আর বিমানে চড়তে হবে না। কেননা বিমানে পেঁয়াজ আমদানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য পেঁয়াজ বিক্রিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে, যার দায় আবার ঘুরেফিরে সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে।  

 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন