সিল্করুট

সমাধিক্ষেত্র যখন স্মৃতি ও লড়াইয়ের অংশ

শিবলুল হক শোভন

যুদ্ধের দিনগুলোয় ওয়াদি আস সালামে বেড়ে যায় মরদেহের সারি ছবি: মর্তুজা সালেহি

কোনো সমাধিক্ষেত্রে মরদেহের ভিড় নিঃশব্দে জানান দেয় ওই অঞ্চলের অস্থিরতা। কারণ হতে পারে দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী কিংবা যুদ্ধ। ২০০৩-১১-এর মাঝে ইরাকের ক্ষেত্রে যে প্রথম তিনটি ঘটেনি তা সবারই জানা। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনের শাসন উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়ে। এ আক্রমণের ফলে ইরাক অস্থিরতা, সহিংসতা ও মৃত্যুর এক চক্রে আটকে যায়। প্রতিদিন অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায় এবং তাদের অনেকের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে ওয়াদি আস সালাম। বিশ্বের বৃহত্তম এ সমাধিক্ষেত্র ইরাক যুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ দমন পীড়নের পরে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ছেড়ে চলে যায়, পেছনে রেখে যায় ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৬৫ মরদেহ।

স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০টির মতো মরদেহ দাফন করা হয় ওয়াদি আস সালামে। কিন্তু ২০০৩-১১ এর মাঝে বেশ কয়েকবার এ হার বেড়ে চার-পাঁচ গুণ হতে দেখা গেছে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য নাজাফের যুদ্ধ (২০০৪), সাম্প্রদায়িক গৃহযুদ্ধ (২০০৬-০৮), সদর সিটি অবরোধ (২০০৮) প্রভৃতি।

নাজাফের যুদ্ধ

নাজাফ শহরেই অবস্থিত ওয়াদি আস সালাম, এখানেই ২০০৪ সালে প্রথম শিয়া স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে আমেরিকান সেনাবাহিনীর তীব্র যুদ্ধ হয়। নাজাফের প্রথম যুদ্ধ বলে পরিচিতি পাওয়া এ লড়াই ছিল মূলত শিয়া মতাদর্শী মাহদি আর্মি ও আমেরিকান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে জোটবাহিনীর। যুদ্ধ এতটাই তীব্র হয় যে কোনো পক্ষই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় না। ২২ দিনের রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে ৩০০-এর ওপর ইরাকি শহীদ হন।

আবারো ২০০৭ সালে নাজাফের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মদদপুষ্ট ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী ও ‘জুন্দ আস সামা’ (বেহেশতের যোদ্ধা) নাম্নি শিয়া মুক্তিকামী বাহিনীর মাঝে এ লড়াই চলে। ২৭-২৮ জানুয়ারি দুইদিনের লড়াইয়ে ৩০০ মুক্তিকামী ইরাকি শহীদ হন।

শিয়াদের কাছে ওয়াদি আস সালামের রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব। নাজাফ শহরেই হজরত আলী (রা.)-এর সমাধি, যা ওয়াদি আস সালামের কাছেই। তারা চায় মৃত্যুর পর সেখানেই সমাধিস্থ হতে, যাতে তারা হজরত আলী (রা.)-এর কবরের কাছে থাকেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন হাশরের ময়দানে তারা হজরত আলী (রা.)-এর নেতৃত্বে একসঙ্গে পুনরুজ্জীবিত হবেন। সে বিশ্বাসকে মনে রেখে সারা বিশ্ব থেকে মানুষের মরদেহ আসে সমাধিস্থ করার জন্য। সেখানে স্থানীয় শিয়া জনতা আরো একাগ্রভাবে ওয়াদি আস সালামে সমাধিস্থ হতে চাইবেন এটাই তো স্বাভাবিক। যুদ্ধের পরে মরদেহ দাফনের চাপ বাড়তে থাকে ওয়াদি আস সালামে। গোরখোদকদের তথ্যানুযায়ী, এ সময়গুলোয় গড়ে ২৫০টির কাছাকাছি মরদেহ প্রতিদিন দাফন করতে হতো, যা তৎকালীন সময়ে এর স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে পাঁচ গুণ। প্রায় ২৪ ঘণ্টাই তাদের কাজ করতে হতো। এ পরিসংখ্যান একই সঙ্গে ইঙ্গিত দেয় যুদ্ধাবস্থার হতাহতের ভয়াবহতা।

ইরাক গৃহযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

২০০৬-০৮ সালের মধ্যে দীর্ঘ দুই বছর দুই মাস ইরাকে শিয়া মতাদর্শের মাহদি আর্মি ও সুন্নি মতাদর্শের আল কায়েদার গৃহযুদ্ধ চলে। যে যুদ্ধে আমেরিকা নেতৃত্বাধীন জোটবাহিনীর সহায়তায় ইরাক সরকারও অংশগ্রহণ করে। মূলত যুদ্ধের শুরু হয় শিয়াদের ধর্মীয় উপাসনালয় আল আসকারি মসজিদে হামলার মধ্য দিয়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ সংবাদ সম্মেলনে সুন্নি মতাদর্শী আল কায়েদাকে দায়ী করেন। শুরু হয় শিয়া-সুন্নি যুদ্ধ। Iraqi Body Count-এর মতে, দীর্ঘ এ যুদ্ধে ৬৯ হাজার ৭৬০ জন ইরাকি মারা যায়।

এ সময় ওয়াদি আস সালামে মরদেহের ভিড় আগের চেয়ে আরো বাড়তে থাকে। এমনকি আমেরিকা ইরাক দখলকালীনের চেয়েও অত্যধিক। জমির হার কমতে থাকায় মরদেহ দাফনের জন্য জমি কেনার খরচ দ্বিগুণ হতে থাকে। এ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমেরিকানরা চলে যাওয়ার পরও চলতে থাকে এবং আরো তীব্র হয়।

সদর সিটি অবরোধ

সদর সিটির অবরোধ (মার্চ-মে ২০০৮) ইরাক যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইরাকি সরকারের মিলিশিয়া নিরস্ত্র করার উদ্যোগে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে। মাহদি আর্মি, শিয়া নেতা মুক্তাদা আল সাদরের অনুগত একটি শক্তিশালী মিলিশিয়া বাহিনী সদর সিটিতে ঘাঁটি গেড়েছিল। এ লড়াই মার্কিন ও ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা ছিল। অবরোধের মূল উদ্দেশ্য ছিল মিলিশিয়াদের রকেট হামলা বন্ধ করা এবং গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো সুরক্ষিত করা। আট সপ্তাহব্যাপী সহিংসতায় প্রায় ৯০০ মিলিশিয়া সদস্য এবং ২১৫ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে অবশেষে ইরাকি বাহিনী সদর সিটির নিয়ন্ত্রণ নেয়, কিন্তু এ সংঘাতের ফলে ওই অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা থেকে যায়।

এসব যুদ্ধই ওয়াদি আস সালামের ওপর রেখে গেছে মরদেহের মিছিলের স্মৃতি। এ নয় বছরে সমাধিক্ষেত্রের আয়তন ৪০ শতাংশ বাড়ে, যা প্রায় ২ দশমিক ৪১ বর্গকিলোমিটারের সমান। তবে ইরাক যুদ্ধের শেষদিকে সমাধিক্ষেত্রে মরদেহের বহর কমতে থাকে। ২০১০ সালে ওয়াদি আস সালামে আসা দৈনিক মরদেহের সংখ্যা ১০০-তে নেমে আসে, যা যুদ্ধকালীন সময়ের অর্ধেকেরও কম।


যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ওয়াদি আস সালাম

ইরাক যুদ্ধের সময় কবরস্থানটি শুধু ধর্মীয় স্থানে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ইরাকি মিলিশিয়াদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে ইরাকি মিলিশিয়ারা বিশেষ করে মুকতাদা আল সদরের নেতৃত্বাধীন মাহদি আর্মি, ওয়াদি আস সালামকে তাদের সামরিক কার্যক্রমের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। মিলিশিয়াদের জন্য কবরস্থানটির গুরুত্ব ছিল কয়েকটি কারণে:

১. আকার ও গঠন: ওয়াদি আস সালামের অসংখ্য সরু গলি, সমাধি ও ভূগর্ভস্থ কক্ষ মিলিশিয়াদের সহজে লুকিয়ে থাকতে এবং দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতে সহায়তা করত। কবরগুলোর মধ্যে অসংখ্য সংকীর্ণ পথ এবং গোলকধাঁধার মতো গঠন মার্কিন বাহিনীকে সেখানে প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণ করতে বাধা দেয়। ফলে মিলিশিয়ারা কবরগুলোর মধ্যে সহজে আক্রমণ চালাতে ও পালাতে পারত।

২. আশ্রয় ও আক্রমণ: মিলিশিয়ারা কবরস্থানটিকে শুধু প্রতিরক্ষার জন্যই নয়, আক্রমণেরও কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করত। শত্রু বাহিনী, বিশেষত মার্কিন সেনারা যখন কবরস্থানের আশপাশে বা ভেতরে প্রবেশ করত, মিলিশিয়ারা কবরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে তাদের ওপর আক্রমণ চালাত। এতে তাদের বিপক্ষের সেনাবাহিনীকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেয়া হতো।

৩. ধর্মীয় স্থান হিসেবে ব্যবহার: যেহেতু ওয়াদি আস সালাম ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মার্কিন বাহিনী সরাসরি সমাধি ধ্বংস বা ধর্মীয় স্থানগুলোয় আঘাত করতে সতর্ক ছিল। এতে শিয়া জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতে পারত। এ ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে ইরাকি মিলিশিয়ারা নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করত, কারণ তারা জানত মার্কিন বাহিনী এখানে কৌশলগত কারণে নির্দিষ্টভাবে আক্রমণ চালাতে সীমাবদ্ধ থাকবে।

মার্কিন বাহিনীর অসুবিধা: ওয়াদি আস সালামের সরু পথ এবং ভেতরের জটিল কাঠামো মার্কিন বাহিনীর ভারী যানবাহন ও বড় বাহিনী পরিচালনা করতে অসুবিধা তৈরি করেছিল। তারা সহজে পুরো এলাকাটি পরিষ্কার বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মিলিশিয়ারা যেকোনো সময় আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে অন্যত্র সরে যাওয়ার সুযোগ পেত।

সমাধিক্ষেত্রের ধ্বংস ও ইরাকি সেনাবাহিনীর অভিযান: যদিও মার্কিন বাহিনী কবরস্থানের ভেতরে অভিযান চালাতে চেয়েছিল, সেখানে সরাসরি আক্রমণের সম্ভাব্য ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে তারা বেশির ভাগ সময় সতর্ক ছিল। তবে ইরাকি বাহিনী মিলিশিয়াদের লুকিয়ে থাকার স্থানগুলোয় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা কবরগুলোর ভেতর দিয়ে নির্মমভাবে পথ তৈরি করত, যাকে অনেকেই ধর্মীয় স্থানের অবমাননা হিসেবে দেখেছে।

ইরাকি বাহিনী কবরস্থানের সমাধিগুলোকে মাটি থেকে মুছে ফেলার জন্য বুলডোজার ব্যবহার করত, ফলে প্রচুর সমাধি ধ্বংস হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা যেসব সংকীর্ণ জায়গায় লুকিয়ে থাকত, ইরাকি সেনাবাহিনী সেখানে নির্মমভাবে ঢুকে পড়ে। তাদের এ পদক্ষেপের ফলে প্রচুর সমাধি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যার ধ্বংসাবশেষ আজও কবরস্থানের পথের পাশে স্তূপাকারে জমা রয়েছে।

মরদেহের মিছিল প্রতীকী হয়ে ওঠে ইরাকের অশান্ত ইতিহাসের, যে ইতিহাস রচিত হয়েছে রক্ত আর মৃত্যুর বুকে। ওয়াদি আস সালাম কেবল একটি সমাধিক্ষেত্র নয়; এটি এক প্রান্তর, যেখানে যুদ্ধের ভয়াল ছায়া, সহিংসতার নির্মম চিহ্ন ও অগণিত নিরীহ প্রাণের হারানো স্বপ্ন একাকার হয়ে থাকে। প্রতিটি সমাধি যেন এক একটি নীরব গল্প, যেখানে জীবনের শেষ অধ্যায় মৃত্যুর এক কোলাহলে মিলিয়ে যায়।

যে ভূমি একদিন শিয়া মতাবলম্বীদের জন্য ধর্মীয় মর্যাদার স্থান ছিল, তা পরিণত হয় যুদ্ধের কৌশলগত ময়দানে। কবরগুলোর সরু পথ আর অন্ধকারময় ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলো হয়ে ওঠে মিলিশিয়াদের লুকিয়ে থাকার আশ্রয়স্থল। প্রতিটি সমাধির পেছনে রয়েছে একটি যুদ্ধ, একটি হারানো জীবন, একটি স্তব্ধ ভবিষ্যৎ।

তবু এ ভিড়ের মধ্যেও কিছু আশা রয়েছে—পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশা, হাশরের দিনে নবজীবনের স্বপ্ন। এ বিশ্বাসেই হয়তো ওয়াদি আস সালামের প্রতিটি সমাধি প্রতিধ্বনিত করে এক নীরব প্রার্থনা, যেন একদিন ইরাকের এ অস্থিরতা মিটে গিয়ে শান্তির শ্বাশত ছায়া ফিরে আসে, আর মৃত্যুর রাজত্বের পরিবর্তে জীবনের জয়গান ধ্বনিত হয়।

শিবলুল হক শোভন: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়