সিল্করুট

তিলোপার দর্শন ও মহামুদ্রা

আহমেদ দীন রুমি

সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত তিলোপার ব্রোঞ্জমূর্তি ছবি: লিন্ডেন মিউজিয়াম

এক তরুণ বাঙালি বসে আছেন গাছের নিচে। পাহারা দিচ্ছেন গরু। পাশাপাশি চোখ বোলাচ্ছেন সঙ্গে থাকা পুথিতে। হঠাৎ এক বিকটদর্শন বৃদ্ধা হাজির হলো সামনে। তাকে জানিয়ে দিল সত্যিকার জ্ঞানের উৎস। যেতে বললেন পশ্চিমের দেশ উরগিয়েনে। সেখানে গিয়ে যেন সরাসরি ডাকিনীদের থেকে জ্ঞান অর্জন করেন। অবশ্য তার জন্য সঙ্গে কাচের মই, মুক্তাশোভিত সেতু আর ঘাসে নির্মিত চাবি থাকতে হবে। কথাগুলো আসলে রূপক। কাচের মইয়ের অর্থ বোঝাপড়ার স্বচ্ছতা। মুক্তাশোভিত সেতু হলো নিখুঁত ধ্যান। ঘাসে নির্মিত চাবি হলো আসক্তিবিহীন কাজ। বৃদ্ধা চলে গেলে চঞ্চল হয়ে ওঠে তরুণের মন। তিনি বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাড়ি জমান উরগিয়েনে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বৌদ্ধ ধর্মের তন্ত্রযান ধারার মহাসিদ্ধ হিসেবে। তার মাধ্যমে কেবল তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মের কাগউ ধারার সূত্রপাতই ঘটেনি। শুরু হয়েছে গাঙ্গেয় মহামুদ্রা নামের মহান শিক্ষার, যা এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে চর্চিত নির্বাণের পথ হিসেবে।

তিলোপা যখন উরগিয়েনে যান, তখন দেখা করেন সেখানকার ডাকিনীদের সঙ্গে। ডাকিনী হলো বিকটদর্শন নারী সত্তা, যারা মানুষের নির্বাণ লাভের জন্য সহায়ক। বৌদ্ধ তান্ত্রিক সমাজে ডাকিনীরা সম্মাননীয়া। চুরাশি মহাসিদ্ধর কাহিনীতে তাদের সিদ্ধসাধিকা ও গুরু—দুটি ভূমিকাতেই দেখা যায়। যা হোক উরগিয়েনে গিয়ে তিলোপা কোনো দ্বিধা বা ভয় না রেখেই সামনে গিয়ে বসেন ভগবতীর। ভগবতীকে তন্ত্রযান বৌদ্ধ ধারায় ডাক ও ডাকিনীর মা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি সব বুদ্ধেরও মাতা। ভগবতীর প্রতি এমন অসম্মানে ডাক-ডাকিনীরা আপত্তি জানালে তিনি নিজেই বাধা দেন। তিলোপাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, সে কেন এতদূর এসেছে। জবাবে তিলোপা মহামুদ্রার জ্ঞানলাভ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথমে বিষয়টা হাস্যকর থাকলেও খুব শিগগিরই সবার সামনে প্রকাশিত হয় তিলোপার যোগ্যতা। ভগবতী তার তিন গুপ্তধন থেকে তিনটি মুক্তা দান করেন। তিলোপা সেদিন থেকেই পরিণত হলেন শেরাব সাংপোতে। শেরাব সাংপো অর্থ গভীর জ্ঞান ও মঙ্গল। তিলোপাকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল উরগিয়েনে থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি থাকেননি। বরং চলে এলেন মানুষের কল্যাণের জন্য। সঙ্গে এল নির্বাণের শিক্ষা। 

মহাসিদ্ধ তিলোপার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান কাগউ ধারার প্রতিষ্ঠা। কাগউ শব্দের অর্থ মৌখিক সিলসিলা। সাধারণত ওস্তাদ থেকে শিষ্যে মৌখিকভাবে শিক্ষা প্রচারিত হয় এক্ষেত্রে। ব্যক্তির মোক্ষপ্রাপ্তির অভিযাত্রায় এ ধারা একদিকে যেমন প্রায়োগিক, অন্যদিকে তেমন পরীক্ষিত। কারণ এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ওস্তাদের তত্ত্বাবধানে থেকে শিষ্য তার জীবনকে পরিশীলিত করতে পারে। তিলোপা অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক বোঝাপড়ার ওপর জোর দেন। তার প্রতিষ্ঠিত ধারা মহামুদ্রা শিক্ষা নামে পরিচিত। মুদ্রা বলতে সিলমোহর বোঝায়। সেদিক থেকে মহামুদ্রা হলো বৃহৎ সিলমোহর। কোনো কিছুকে সিল করার মানে চূড়ান্ত করা। অর্থাৎ এর বাইরে আর কোনো চূড়ান্ত সত্য নেই। মহামুদ্রা অনুসারে, চারপাশের সবকিছুই নিখুঁত। আদতে প্রকৃতির কোনো কিছুর মধ্যেই কোনো প্রকার খুঁত নেই। সমস্যা ব্যক্তির অজ্ঞতায়। ব্যক্তি নিজের সত্যিকার সত্তাকে চিনতে পারে না বলেই মন অস্থির হয়ে যায়। আর মনের মধ্যে স্থিরতা না থাকলেই তৈরি হয় পক্ষপাত। পক্ষপাতের মধ্য দিয়ে যে বোঝপড়া, তা সত্যিকার অর্থে বোঝাপড়া নয়। ফলে নিজেকে জানার মধ্য দিয়েই নির্বাণ সম্ভব। কেউ যখন নিজেকে জানতে পারে, তখন সংসারই তার জন্য নির্বাণ হয়ে যায়। তার জন্য প্রতিবন্ধকতা পরিণত হয় সুযোগে, বিষাদ রূপ নেয় সুখে। একেই বলে আত্মমুক্তি। তখন আর সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করার দরকার পড়ে না। কারণ তখন সমস্যা নিজেই সমাধান হয়ে ওঠে। যে এ মহামুদ্রা রপ্ত করে ফেলে, সে মূলত সবকিছুই বুঝে ফেলে। 

তিলোপার মহামুদ্রার সারকথা হলো, জ্ঞান আর শূন্যতা অবিচ্ছেদ্য। সম্ভবত তিলোপার সব শিক্ষার মৌলিক পাটাতন মহামুদ্রা। এটা মূলত মনের সার ও চারপাশের বিষয়াবলির প্রকৃতি বুঝতে পারার ব্যাকরণ। জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। মোক্ষপ্রাপ্তির পথে সূত্র ও তন্ত্রের প্রয়োগ এবং ভিন্ন ধারার প্রয়োগের কারণে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে মহামুদ্রা পৃথক জায়গা দখল করে আছে। মহামুদ্রার জন্য সবার আগে দরকার মনোযোগ। পাশাপাশি রয়েছে বিপশ্যনা বা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন এবং অদ্বৈত অভিজ্ঞতা। এর মধ্য দিয়ে চর্চাকারী বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে উপনীত হয় সত্যিকার অর্থপূর্ণ জীবনে। চারপাশের বাস্তবতা ও মনকে জানার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল তিলোপার। এজন্য তিনি ছয়টি বিশেষ উপদেশ দেন। এই ছয় উপদেশকে সম্ভবত তিলোপার শিক্ষার সার হিসেবে হাজির করলে খুব একটা বড় করে বলা হবে না। এদের প্রতিটিই পৃথকভাবে একেকটা স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথমত, কোনো কিছু মনে না রাখা। অর্থাৎ অতীতের যা কিছু গেছে, তাকে মন থেকেও চলে যেতে দেয়া। তাকে ধরে রেখে বা মনে রেখে কোনো কাজ নেই। অনুশোচনা বা কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, কল্পনা না করা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে অযথা উৎকণ্ঠা করে সময় নষ্ট করার কিছু নেই। তাতে কেবল অশান্তিই তৈরি হবে অন্তরে। তৃতীয়ত, চিন্তা না করা। এক্ষেত্রে তিলোপার দাবি, কোনো কিছু নিয়েই অতিরিক্ত চিন্তা করা ভালো না। বর্তমানকে যাপন করাই জীবনের সারকথা। একে বৌদ্ধিকীকরণ বা যৌক্তিক করার চেষ্টার কোনো মানে নেই। চতুর্থত, পরীক্ষা না করা। অর্থাৎ নিজের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে গবেষণা করার দরকার নেই। যা অভিজ্ঞতা তাকে অভিজ্ঞতা আকারেই গ্রহণ করতে হবে। পঞ্চমত, নিয়ন্ত্রণ না করা। অর্থাৎ তিলোপার দাবি, পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বাসনা ত্যাগ করা। কারণ নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা থেকে আসক্তি ও আসক্তি থেকে অশান্তি তৈরি হয়। ষষ্ঠত, বিশ্রাম নেয়া। অর্থাৎ মনকে স্থির রাখা। প্রাত্যহিক যুক্তি ও বিযুক্তির প্রক্রিয়ায় নিজেকে স্থির রাখা। 

তিলোপা যেহেতু নারোপাকে গঙ্গার তীরে বসে শিক্ষা দিতেন, তাই তার মহামুদ্রার নাম হয়েছে গাঙ্গেয় মহামুদ্রা। পৃথিবীতে বহু পুস্তক রচয়িতার নামে পরিচিতি পায়, কিছু বই পায় বিষয়বস্তু অনুসারে নাম। সেদিক থেকে তিলোপার উপদেশের নামকরণ হয়েছে স্থানের নামে। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে তার শিক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে শিষ্যদের হাত ধরে। মহামুদ্রাটি মূলত বজ্রডাকিনীর প্রতি শ্রদ্ধা। তিব্বতে বেশ কয়েকটা সংস্করণ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মহামুদ্রা শুরু হয়েছে ‘বজ্রডাকিনীর প্রতি শ্রদ্ধা’ লাইন দিয়েই। বজ্রডাকিনী সব বুদ্ধের মা। সব বুদ্ধ জন্ম নেন সেখান থেকে। গাঙ্গেয় মহামুদ্রার প্রধান বয়ান হলো, কোনো কিছুই পরিবর্তনের দরকার নেই। যা যেভাবে আছে, তাকে সেভাবে গ্রহণ করা। মহামুদ্রায় স্থির হতে পারলে সব নেতিবাচক চিন্তা সরে যায়, মন হয় আকাশের মধ্যভাগের মতো শূন্য ও পরিষ্কার। গাঙ্গেয় মহামুদ্রায় বলা হচ্ছে, ‘যদি চাও নিরীক্ষা করো দুনিয়াবি বিষয়গুলো। দেখবে কোনো কিছুই দিন শেষে থাকে না। কোনো কিছুই চিরস্থায়ী হতে পারে না। সেদিক থেকে দেখলে সবকিছু যেন স্বপ্ন কিংবা মায়াজালের মতো। স্বপ্নই হোক আর মায়াজাল, তারা অর্থহীন। ফলে দুনিয়াবি বিষয়কে ত্যাগের মনোবৃত্তি তৈরি করো। ছিন্ন করে চারপাশের জগতের প্রতি সব ধরনের আসক্তি। ধ্যান করো নির্জনতায়। আর বসবাস করো একা। সেই অবস্থায় থাকো ধ্যানে না থাকলেও। যখন তা অর্জন করতে পারবে, তার মানে তুমি মহামুদ্রা অর্জন করে ফেলেছ। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক একটা গাছের অনেক ডালপালা, ফুল ও ফল, কিন্তু তার শেকড় একটা। যদি সেই একমাত্র শেকড়টা কেটে ফেলা যায়, তাহলে হাজারো ডালপালা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শুকিয়ে যাবে। একইভাবে যদি মনের শেকড় কেটে ফেলা যায়, সংসারের ডালপালা ও পাতাগুলোও শুকিয়ে যাবে।’

তিলোপার প্রধান শিষ্য নারোপা। আশ্চর্যজনকভাবে, এই নারোপাও সম্ভবত বাঙালি ছিলেন। ছিলেন নালন্দা মহাবিহারের শিক্ষক ও মহাসিদ্ধ। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে তিনি তিলোপার কাছ থেকে মহামুদ্রা অর্জন করেন। তিলোপার প্রতিষ্ঠিত কাগউ ধারার পরবর্তী পুরুষও নারোপাই। তার অন্য শিষ্যদের মধ্যে রয়েছেন শবরী, ইন্দ্রভূতি ও মৈত্রীপা। প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে মহামুদ্রার শিক্ষা দান করেছেন। কেউ তিব্বতে আর কেউ ভারতে আর কেউ বাংলায় প্রচার করেছে তিলোপার শিক্ষা। ভারতীয় ইতিহাসে ৮৪ জন মহাসিদ্ধের একজন ছিলেন তিনি। কাগউ ধারার প্রথম উৎস বজ্রধর বা আদিবুদ্ধ। তাকেই মনে করা হয় সব বোধের উৎস। তারপরে প্রথম শিক্ষক তিলোপা, যিনি বজ্রধরের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মহামুদ্রা এবং তন্ত্র। তারপর তার মধ্য দিয়েই নারোপা, মরোপা, মিলারেপা ও গামপোপা হয়ে প্রসিদ্ধ হয়ে প্রচারিত হয়েছে বুদ্ধের শিক্ষা। কাগউ ধারার প্রধান কিতাব হচ্ছে কাগউর এবং তেংউর। সেখানে বাংলার তিলোপা ও নারোপা ছাড়াও তিব্বতীয় যোগী মরোপা, মিলারেপা ও গামপোপা ও কর্মপা ও অনেক ওস্তাদের নাম যুক্ত। তারপর এ সিলসিলা এগিয়ে গেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। তার শিক্ষা আধুনিক আধ্যাত্মিকতায় ব্যবহার করা হয়। আধুনিক থেরাপিতে কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রভাব।

পাল আমলের বাংলা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের স্বর্ণভূমি। তন্ত্রযান ধারার বৌদ্ধ বিশ্বাসের সূত্র ধরে বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল তিব্বতের। বাঙালি পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের তিব্বত যাত্রার মহাকাব্যিক বর্ণনা বহুল প্রচলিত। অথচ আরেক বাঙালি পণ্ডিত তিলোপা ও তার মহান দর্শন গাঙ্গেয় মহামুদ্রা অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হলেও তার ভূমিকা নেহাত কম নয়।

আহমেদ দীন রুমি: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা