আইএফআইসি ব্যাংকের আমানতকারীদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই

মো. মেহমুদ হোসেন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

মো. মেহমুদ হোসেন। আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসির নতুন চেয়ারম্যান। সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকটির সংস্কার ও পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি এ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। চার দশকের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ ব্যাংকার ন্যাশনাল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদেও ছিলেন। আইএফআইসির আর্থিক পরিস্থিতি, সুশাসন ও সংস্কার নিয়ে তিনি কথা বলছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমামূল হাছান আদনান

আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার দুই সপ্তাহ পেরোল। এ কয়দিনের হোমওয়ার্ক শেষে আপনার মতামত কী? এ ব্যাংকের সবচেয়ে শক্তির জায়গা কোনটি?

আইএফআইসি দেশের প্রবীণতম ব্যাংক। ১৯৭৬ সালে সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কমার্স (আইএফআইসি) নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপ নেয়। এখন আমরা অনেকেই পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) নিয়ে আলাপ করছি। সরকার এটি নীতি হিসেবে নিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। অথচ সেই সত্তরের দশকে বিষয়টি নিয়ে তেমন কেউ না জানলেও এ রকম এক পিপিপি থেকেই আইএফআইসির জন্ম। সেদিক থেকে এটি ব্যাংক খাতের জন্য একটি ইউনিক প্রপোজিশন ছিল। এটা আমি মনে করি একটা বড় শক্তির জায়গা। শুরুর দিকে দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সরকারের ৫ শতাংশ শেয়ার ও পর্ষদে একটি সিট ছিল। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল আইএফআইসি ব্যাংক। কারণ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ ব্যাংকের ৩২ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা ছিল সরকারের। এটি এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে। সেদিক থেকে আইএফআইসির অবস্থান অনেক সুদৃঢ়। সরকারের যে চিন্তাভাবনা ও এস্টাবলিশমেন্ট রয়েছে, তার সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের চিন্তাভাবনার সম্মিলন রয়েছে এখানে। 

আরেকটি বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে এ ব্যাংকের বিস্তৃতি। গত ১০-১২ বছরে আইএফআইসি নিজেদের নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে বিস্তৃত করেছে। ব্যাংকটি দাবি করে, তারা দেশের সর্ববৃহৎ নেটওয়ার্কসম্পন্ন ব্যাংক, যা বাস্তবতার নিরিখে যথার্থ। এ বিস্তৃত নেটওয়ার্কের ফলে আইএফআইসি ইনক্লুসিভ ব্যাংকিংয়ের গতিপথকে সুনির্দিষ্ট করে নিজেদের ভিশনের মধ্যে নিয়ে এসেছে। বিস্তৃত এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যাংকটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ইনক্লুসিভ ব্যাংকিং সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিচ্ছে। আইএফআইসির ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ গ্রাহকরা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। এ সেবার মাধ্যমে ২০-২১টি ব্যাংকিং সেবা এক বসায় এক ডেস্ক থেকে গ্রাহকদের দেয়া হচ্ছে। সাধারণত ব্যাংকিংয়ের সেবাগুলো বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে বিভিন্ন ডেস্কে বিস্তৃত থাকে। গ্রাহককে বিভিন্ন সেবা গ্রহণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। আইএফআইসি এক ডেস্কেই গ্রাহকদের সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করেছে।

আপনি বলছিলেন আইএফআইসির শক্তির জায়গা ইনক্লুসিভ ব্যাংকিং প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়া। সেখান থেকে আপনারা আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণসহ অন্যান্য খাতে কী ধরনের ফিডব্যাক পাচ্ছেন? 

একটা ইতিবাচক ও শক্তিশালী ফিডব্যাক আছে। পুরনো ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও তিন-চার বছর আগেও আইএফআইসি ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। গ্রাহক সংখ্যার যে দ্রুত বৃদ্ধি ও বিস্তৃতি তা ঘটেছে মূলত ‘প্রতিবেশী’ (উপশাখা) স্থাপন ও ‘আমার অ্যাকাউন্ট’ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে। আইএফআইসির সব উপশাখাকে প্রতিবেশী বলা হয়, যা আইএফআইসির সেবাকে একেবারে গ্রাহকের ঘরের পাশে নিয়ে গেছে। আপনি ঘর থেকে বের হলেই যেমন প্রতিবেশীকে দেখতে পান, তেমনি আইএফআইসিকেও দেখতে পাবেন। এ প্রতিবেশী স্থাপন ও আমার অ্যাকাউন্ট সেবা চালু হওয়ার পর প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার করে নতুন গ্রাহক আসছেন আমার অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে। আইএফআইসি নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি, ইনক্লুসিভ ব্যাংকিংয়ের প্রয়াস এবং আমার অ্যাকাউন্ট উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবায় যে নতুনত্ব এনেছে, সেটি গ্রাহক সাদরে গ্রহণ করেছেন।

আইএফআইসির অবয়ব তথা আমানত ও ঋণের স্থিতি, শাখা-উপশাখার বিস্তৃতি এখন কেমন?

গত বছরের ডিসেম্বরে আইএফআইসি আমানতের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক অর্জন করে। আমাদের ৪৪-৪৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ স্থিতি রয়েছে। অবয়বের মধ্যে স্টক মার্কেটে অপারেট করার জন্য আমাদের সাবসিডিয়ারি আছে দেশের মধ্যে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমটি যদিও খুব বেশি ভালো করছে না মার্কেটে, যার সংগত কারণও আছে। তার পরও এর অস্তিত্ব আছে এবং বাজারে আমাদের উপস্থিতি আছে এটুকু বলতে পারি। এছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থ নির্বিঘ্নে ও ঝুঁকিমুক্তভাবে দেশে আনতে আমাদের মানি এক্সচেঞ্জ কাজ করছে। এ মুহূর্তে সারা দেশে আইএফআইসির ১ হাজার ২১৬টি উপশাখা ও ১৮৮টি শাখা রয়েছে।

সুশাসনের ঘাটতির কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএফআইসির পর্ষদ ভেঙে দিয়ে আপনাদের নিয়োগ দিয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বিতরণকৃত ঋণের গুণগত মান কেমন দেখলেন? গ্রাহকদের যে আমানত সঞ্চিত আছে তা কতটা সুরক্ষিত রয়েছে? 

আইএফআইসি ব্যাংকে অবশ্যই সুশাসনের ঘাটতি ছিল। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিল। এ সুশাসনের ঘাটতি থাকার কারণেই ব্যাংকের বিনিয়োগের একটি অংশ যে মাপকাঠি অনুসারে পেশাদারত্ব বজায় রেখে হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে হস্তক্ষেপ করেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের হস্তক্ষেপের ফলে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কিছু ভুল ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যা এ ব্যাংকের বিনিয়োগের মানকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাইনি, আগামী সপ্তাহের মাঝেই হয়তো পেয়ে যাব।

তবে যতটুকু জেনেছি, যে ১১টি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করেছে, তার মধ্যে আইএফআইসির ক্ষত অন্যদের মতো অত গভীর নয়। এটি আয়ত্তের মধ্যেই আছে। বিনিয়োগ নিয়ে এত উৎকণ্ঠার কোনো কারণ দেখছি না। এটি মেরামতযোগ্য, তবে হয়তো সময়ের ব্যাপার। আমরা যদি যথাযথ কৌশল প্রয়োগ করে এগোতে থাকি সেক্ষেত্রে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আইএফআইসিতে যারা আমানত রেখেছেন তাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমানতকারীরা কোনো টাকা তুলতে এসেছেন বা অন্য ব্যাংকে ট্রান্সফার করতে এসেছেন এমন ক্ষেত্রে আইএফআইসি ব্যাংক কোনো চেক, এফডিআর বা গ্রাহককে পেমেন্ট দিতে পারেনি এমন ঘটনা নেই। 

তার মানে আইএফআইসির নগদ প্রবাহ একদমই স্বাভাবিক আছে?

আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক আছে। আমি বিশ্বাস করি, নগদ প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবভিত্তিক যে ধরনের অপপ্রচার ও কম জ্ঞানভিত্তিক মতামত বা রিপোর্ট ছড়ানো হয় তার ভিত্তিতে কিছু আমানতকারী বিভ্রান্ত ও শঙ্কিত হচ্ছেন। কিছু বিষয় ছাড়া আমাদের আমানতকারীদের মধ্যে আমরা এখনো আস্থায় চিড় ধরার মতো কিছু দেখতে পাইনি।

আপনি বলতে চাচ্ছেন, অন্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বা আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি হয়েছে তা আইএফআইসির ক্ষেত্রে ঘটেনি?

না, আস্থাহীনতার মতো কোনো ঘটনা একদমই ঘটেনি। আমি মনে করি, আমানতকারীদের মধ্যে এখন আইএফআইসি ব্যাংক নিয়ে আস্থা আরো শক্তিশালী হওয়ার কথা। কারণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি পর্ষদ বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে। যার যার ক্ষেত্রে বিস্তর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও পেশাদার দক্ষ লোকদেরই পর্ষদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সুতরাং এখানে এখন আস্থা আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। 

আইএফআইসি ব্যাংকের পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আমানতকারীদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কী?

আমি একটি পরিষ্কার বার্তা দিতে চাই। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। এটি অনেক কষ্টার্জিত এবং অনেক জীবনের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা এসেছে। এ স্বাধীনতা নতুন করে আমাদের দেশকে সংস্কার করার সুযোগ দিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা ছোট ছিলাম। তখন আমরা বলেছি দেশ গঠন করা হচ্ছে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, দেশ সংস্কার করা হচ্ছে। এ দেশটাকে আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দেয়ার জন্য, আগামী দিনে শক্ত-সবলভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য যে সংস্কারগুলো করা দরকার সেগুলোই হচ্ছে। আমরা বলব, আইএফআইসিও সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

বর্তমান পর্ষদের নেতৃত্বে আইএফআইসির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও ঢেলে সাজিয়ে আরো গতিশীল করা হবে। প্রফেশনাল জ্ঞান সবারই আছে, কারো কম বা কারো বেশি। কিন্তু আজকের এ বিপর্যয় যে কারণে এসেছে তা হলো অন্ধ আনুগত্য। পেশাদারত্বকে ভুলিয়ে দিয়ে অন্ধভাবে চলার ফলে ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দায়িত্ববানদের ভেতরের ন্যায়-নীতিবোধ ও ব্যাংকিং নীতির অবক্ষয়ের ফলে এটি ঘটেছে। আমরা আমাদের কর্মীদের মধ্যে নীতি ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে চাই। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ সব পদক্ষেপই নেয়া হবে। আইএফআইসি শুধু আমানত সংগ্রহের জন্য এত বৃহৎ নেটওয়ার্ক তৈরি করেনি। উপশাখাগুলোর মাধ্যমে আমরা এসএমই, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কাজ করব। স্থানীয় ছোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে সহায়তা করাই আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন