ব্যাংক
খাত সংস্কারের একটি প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা
পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে, যার
অধিকাংশ পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ব্যাংক। পুনর্গঠিত পর্ষদগুলোর কাজের পরিধি কী হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে
জানা না গেলেও মোটা দাগে অনুমান করা যায় যে তাদের মূল কাজ হবে ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা,
অনিয়মগুলো চিহ্নিত করা ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ
করা, গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা পুনরায়
সৃষ্টি করা, বিনিয়োগগুলো যথাসম্ভব
পুনরুদ্ধার করা এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা। ব্যাংকিং
সেবার বৈশিষ্ট্যগত
পার্থক্য ও সর্বক্ষেত্রে শরিয়াহ পরিপালনের বাধ্যবাধকতার কারণে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর
ক্ষেত্রে সংস্কারকাজের পরিধি হবে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো থেকে বেশি। অতিরিক্ত
কাজগুলো নির্ধারণে অতীত-বিদ্যমান ভালো
চর্চাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থার আন্তর্জাতিক মান
নির্ধারক সংস্থাগুলোর ও অগ্রগামী দেশগুলোর বিধানগুলো বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম
অতিরিক্ত যে দায়িত্বগুলো
সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন তার কিছু সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করছি,
যা কেবল ইসলামিক ব্যাংকগুলোর বর্তমান পর্ষদগুলোর জন্য নয়,
বরং ভবিষ্যতেও প্রযোজ্য হবে। এখানে খেয়াল রাখা
প্রয়োজন যে যেহেতু সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে
নিবন্ধটি লেখা হয়েছে, আলোচনার
প্রাসঙ্গিকতায় কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতার উদাহরণ দেয়া হয়েছে যা সব ব্যাংকে সবসময়
বিদ্যমান নাও থাকতে পারে।
ইসলামিক
ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে যথাযথ শরিয়াহ পরিপালন
ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও নিশ্চিত করা যে ব্যাংকের যাবতীয় কার্যক্রম শরিয়াহ
নীতিমালা মেনে পরিচালিত হচ্ছে। এ দায়িত্ব পালনে তাদের একটি শক্তিশালী শরিয়াহ গভর্ন্যান্স ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা
প্রয়োজন এবং নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়
শরিয়াহ নীতিমালা একীভূত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানজুড়ে শরিয়াহ পরিপালনের সংস্কৃতি
প্রতিষ্ঠা ও কর্মীদের মধ্যে ইসলামিক নৈতিক মূল্যবোধ
স্থাপনের যথোপযুক্ত উদ্যোগ নেয়াটা তাদের দায়িত্ব। বাংলাদেশের একাধিক ইসলামিক
ব্যাংকের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে যদিও তারা
সর্বক্ষেত্রে শরিয়াহ পরিপালনের একটি সাধারণ দাবি করেছে এবং
এ-সংক্রান্ত
কিছু বিবরণ যোগ করেছে, কিন্তু
এক্ষেত্রে পর্ষদের দায়, দায়িত্ব
ও ভূমিকার সুস্পষ্ট বিবরণ অনুপস্থিত।
পর্ষদগুলোর
অন্যতম আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে,
ব্যাংকের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রমে শরিয়াহ বিচ্যুতি ঝুঁকিকে গুরুত্ব দেয়ার নীতি প্রতিষ্ঠা
করা এবং যেকোনো বিচ্যুতি চিহ্নিত করার ও অনতিবিলম্বে যথাযথ পর্যায়ে
(যেমন শরিয়াহ কমিটি,
পর্ষদ বা বাংলাদেশ ব্যাংককে)
অবহিত করার সুনির্দিষ্ট ও ভীতিহীন ব্যবস্থা নিশ্চিত
করা। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে কর্মী পর্যায়ে শরিয়াহ বিচ্যুতি নিয়ে উদ্বেগ
প্রকাশ করলেও যথাযথ পর্যায়ে অবহিত করার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকার
ফলে সেসব বিষয় কেবল ব্যক্তিগত আলাপে বা সীমিত গণ্ডিতে
সীমাবদ্ধ থাকে, প্রতিকার-প্রতিরোধমূলক
কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। বিষয়টি যদি মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনা করি,
সেখানে শরিয়াহ বিচ্যুত হয়েছে এমন একটি সম্ভাবনা চিহ্নিত
করার পর কত দিনের
মধ্যে কী
পদক্ষেপ কাকে নিতে হবে তার সুস্পষ্ট বিধান কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক দেয়া হয়েছে। এছাড়া
শরিয়াহ বিচ্যুতিতে জড়িত থাকলে বা বিচ্যুতির ঘটনা জেনেও যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে কঠোর
শাস্তির বিধান আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
যথাযথ
যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে শরিয়াহ কমিটি গঠন,
শরিয়াহ কমিটির সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন এবং এ লক্ষ্যে ম্যানেজমেন্টের
নেয়া পদক্ষেপগুলোর পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করাও পর্ষদের দায়িত্ব। একই সঙ্গে তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে শরিয়াহ কমিটি সদস্যদের
ক্রমাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ,
স্বাধীনতা ও যথাযথ সম্মানী নিশ্চিত করা। শরিয়াহ কমিটির কার্যকারিতা নিশ্চিতে (বিশেষত
শরিয়াহ সেক্রেটারিয়েট, গবেষণা,
নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষায়) যোগ্য ও পর্যাপ্ত লোকবল
নিশ্চিত করাটাও পর্ষদের দায়িত্ব।
শরিয়াহ
কমিটি সদস্যরা
অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্রিয় ছিলেন কিনা ও কমিটির কার্যক্রমে কার্যকর অবদান
রেখেছিলেন কিনা তা মূল্যায়নের কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করাটা পর্ষদের অন্যতম
একটি দায়িত্ব। অন্য অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন
মালয়েশিয়া, বাহরাইন,
ওমান ও কুয়েত)
এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন
কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকার ফলে কোনো ইসলামিক ব্যাংক এ মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
করেছে বলে শোনা যায়নি।
অভ্যন্তরীণ
শরিয়াহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপাদানগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত করা ও শরিয়াহ নিরীক্ষকদের
স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা পর্ষদের দায়িত্ব। অতীতে শোনা গেছে যে
বিচ্যুতি চিহ্নিত করার ফলে শরিয়াহ নিরীক্ষক ওপরের
পর্যায় থেকে চাপের সম্মুখীন হয়েছেন। এমনও শোনা গেছে যে শরিয়াহ নিরীক্ষক ব্যাংকের
ব্যবসায় কীভাবে
ভূমিকা রেখেছেন সেটি গর্ব করে বলছেন, যা
নিরীক্ষকের স্বাধীনতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে ও দুর্বল শরিয়াহ নিয়ন্ত্রণ
ব্যবস্থার ইঙ্গিত প্রদান করে।
গুটিকয়েক
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়া,
ঝুঁকিবণ্টন
পদ্ধতির পরিবর্তে ঝুঁকি হস্তান্তর পদ্ধতির ব্যাপক চর্চা ও দায়ভিত্তিক অর্থ
ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরা শরিয়াহর চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের সঙ্গে
সংগতিপূর্ণ
নয়। সম্পদের সুষম বণ্টন
ও বৈষম্যবিরোধী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা শরিয়াহর চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের
অন্তর্ভুক্ত। পর্ষদের সিদ্ধান্তগুলোয়
এ চিন্তাধারা প্রতিফলিত হওয়াটা জরুরি। একই সঙ্গে
ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থা বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন করাও পর্ষদ সদস্যদের দায়িত্ব।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় পর্ষদ সদস্যদের কাছ থেকে এমনটা প্রত্যাশা অবাস্তব বিবেচিত
হয়ে আসছে। শোনা যায় যে পর্ষদ সদস্যদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে অতীতে একাধিক উদ্যোগ নেয়া
হলেও তাদের কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। আশা করা যায় যে নতুন বাংলাদেশে এমন অবস্থার
পরিবর্তন হবে।
ইসলামিক
ব্যাংকিং সেবা বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতনতা
বৃদ্ধিতেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইট ও
অন্যান্য মাধ্যম থেকে বিভিন্ন সেবার বিস্তারিত বর্ণনা,
শরিয়াহ ভিত্তি,
গ্রাহকের দায়িত্ব ও অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো
তথ্য পাওয়া যায় না। দূর অতীত তথ্য প্রকাশের চেষ্টার একটা আভাস থাকলেও সময়ের সঙ্গে এ অবস্থার অবনতি হয়েছে।
তথ্যের
প্রাপ্যতা বিশেষভাবে প্রয়োজন আমানতকারীদের প্রেক্ষিতে, কারণ মূলত তাদের
টাকাতেই ব্যাংক পরিচালিত হয়। ইসলামিক ব্যাংকের আমানতের একটি অনন্য দিক হচ্ছে যে এর
বড় অংশ আসে মুদারাবাহ চুক্তির ভিত্তিতে, যেখানে শরিয়াহ দৃষ্টিতে আমানতকারীরা বিনিয়োগঝুঁকি বহন করেন ও বিনিয়োগের
লাভের পরিমাণের ওপর
সরাসরি নির্ভর করে আমানতকারীদের লাভের পরিমাণ। ফলে আমানতকারীদের প্রতি একটি
ইসলামিক ব্যাংকের দায়বদ্ধতা একটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক থেকে বহুগুণ বেশি। অথচ
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে এ দায়বদ্ধতা পূরণে যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
নিশ্চিত করা প্রয়োজন তার যথেষ্ট ঘাটতি বিদ্যমান। আমানতকারীদের অর্থ ব্যবস্থাপনা,
বিনিয়োগ, লাভ
হিসাবনিকাশ ও বণ্টন
ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ গ্রাহকের আস্থা অর্জনে ও শরিয়াহ অনুসরণের
নিশ্চয়তা প্রদানের দৃষ্টিতে এ ধরনের তথ্যের প্রাপ্যতা জরুরি। আশা করা যায় যে নতুন
বাংলাদেশে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর পর্ষদগুলোর
কার্যকরী ভূমিকায় আমানতকারীদের প্রতি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
ইসলামিক
ব্যাংকগুলোর নতুন পর্ষদগুলোর
এছাড়া পুনঃযাচাই করা প্রয়োজন যে বিদ্যমান ইসলামিক ব্যাংকিং সেবাগুলোর গঠন,
নির্দেশিকা ও চুক্তিগুলো
এবং জাকাত
ও দাতব্য তহবিলের বণ্টন
শরিয়াহ কমিটির যথাযথ অনুমোদনের ভিত্তিতে হয়েছে কিনা। শরিয়াহ কমিটির সিদ্ধান্তগুলো আন্তর্জাতিক শরিয়াহ মান
অনুসরণ করে হয়েছে কিনা সেটিও পুনঃযাচাই করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে পুনঃযাচাই করা প্রয়োজন যে
ব্যাংকের প্রযুক্তি ব্যবস্থা শরিয়াহ বিচ্যুতি প্রতিরোধে সক্ষম কিনা। ইসলামিক
ব্যাংকিং সেবার বিষয়ে বহুজনের বহু অভিযোগ-আপত্তি-সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে এ কাজগুলো
জরুরি। গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক শরিয়াহ মানের বিপরীতে বহিঃশরিয়াহ
নিরীক্ষা ও বহিঃশরিয়াহ রেটিং করার সম্ভাবনা পর্ষদগুলো
বিবেচনায় নিতে পারে।
উপরোক্ত
বিষয়গুলো পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি,
ব্রাঞ্চ ও উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং যেসব
প্রচলিত ধারার ব্যাংক পরিচালনা করছে তাদের পর্ষদদেরও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ইসলামিক
বীমা বা তাকাফুল প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও এগুলো প্রযোজ্য।
পরিশেষে
ইসলামিক ব্যাংকগুলোসহ অন্য যেসব ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন হয়েছে তাদের অন্যতম প্রথম
কাজ হবে কর্মীদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করা। শোনা যাচ্ছে যে কোনো কোনো
ক্ষেত্রে এখনো
কর্মীদের মধ্যে ভয় ও পর্ষদের প্রতি সন্দেহ বিদ্যমান। বিভিন্ন কারণে এমনটা হতে
পারে। কারণ যা-ই
হোক, পর্ষদের দায়িত্ব আস্থার
সম্পর্ক সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। বিশেষ বিবেচনা করা প্রয়োজন যে সংস্কারের
কাজটি করতে হবে এখনই যেহেতু এখন বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবার পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া
যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ সংস্কার হবে ভবিষ্যতের গভর্ন্যান্স ও ব্যবস্থাপনার ভিত্তি।
মেজবাহ
উদ্দিন আহমেদ:
মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থার উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য
প্রতিষ্ঠিত ইন্সইফ ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন।