উচ্চ শিক্ষায় সংস্কার

ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নাকি সংস্কার

ছবি : বণিক বার্তা

সম্প্রতি ছাত্র রাজনীতি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৯৬ ভাগ শিক্ষার্থী মনে করেন ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত করে। প্রকৃতই ছাত্র রাজনীতি উচ্চ শিক্ষার অন্তরায় কিনা—এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের মতামত তুলে ধরেছেন আনিসুর রহমান

মো. সাইফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোর সুযোগ পান, তখন অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন। অনেক বড় হবেন, পরিবারের হাল ধরবেন, পরিবারের দুঃখ ঘুচাবেন—আরো কত শত স্বপ্ন বোনেন মনে মনে! কিন্তু যখনই অপরাজনীতির সম্মুখীন হন, ঠিক তখনই সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শুধু ছাত্র রাজনীতির কারণেই শত শত শিক্ষার্থী নিজের স্বপ্নের ক্যারিয়ার গড়তে ব্যর্থ হন। যে সময়ে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার কথা ছিল, ঠিক সে সময় ‘পলিটিক্যাল বড় ভাই’ নামক কতিপয় কুলাঙ্গার জোর করে তার নেতার কাছে হাজিরা দিতে নিয়ে যায়। যদি কেউ যেতে রাজি না হয়, তাহলে তার ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন এবং শেষ পর্যন্ত তার মাথা গোঁজার ঠাঁই হল থেকে বের করে দেয়া হতো। সেই সঙ্গে জুটত বিরোধী ‘শিবির’ তকমা। যদি কেউ তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদও করতে যান, দলীয় ক্যাডাররা হত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধা করত না। তাই দলীয় ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে থাকলে সবসময় এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বহাল থাকবে। শিক্ষার্থীরা মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারবেন না। পারবেন না স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে। অন্যদিকে এ বাজে ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে না থাকলে একজন শিক্ষার্থী খুব সুন্দরভাবে তার ক্যারিয়ার গড়ার দিকে মনোযোগী হতে পারবেন। উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে পরিবারের হাল ধরতে পারবেন। দেশ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবেন।

সুমাইয়া শিকদার 

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

রাজনীতির প্রতি আমাদের অনেকের কিছু ভীতি কাজ করে বা এ বিষয়কে নেগেটিভভাবে দেখি৷ কিন্তু কেন? কারণ বিগত ক্ষমতাসীন রেজিমের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দলগুলো আমাদের ওপর তাদের স্বৈরাচারী অমানবিক ও ন্যক্কারজনক ভাবমূর্তি নিয়ে সর্বদা হাজির থাকত। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিত, তাদের ওপর হামলা করত, এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করত না। আমি নিজেও এসবের শিকার হয়েছি।  আমি মনে করি এই যে রাজনীতির অপব্যবহার প্রথমে এটা গোড়া থেকে ধ্বংস করতে হবে। এ দায়িত্ব সরকারি বা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিতে হবে। কারণ বিগত রেজিমগুলো ক্ষমতায় থেকেই এগুলো করে এসেছে। এখন যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা না করা হয় তাহলে সেই "নতুন বোতলে পুরনো মদ যেই কথা প্রচলিত আছে পুনরায় তারই বাস্তবায়ন হবে। উচ্চ শিক্ষা বাস্তবায়ন করার জন্য অবশ্যই সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ লাগবে। উন্নত গবেষণা নিশ্চিত করতে হবে এবং গবেষণার পরিবেশ লাগবে। আমাদের দেশে লাইব্রেরি খুব কম, অপর্যাপ্ত বই এবং প্রয়োজনীয় অনেক শিক্ষা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই সংকটে থাকে। শিক্ষকদের আরো প্রশিক্ষণ ও চর্চার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা দেখব এ সংকটগুলো কম।

সৈয়দ শোয়েব আবদুল্লাহ সাকিব

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির গোড়াপত্তন হয় ইংরেজ শাসনামলে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনীতি সাধারণত দুটো ধারায় হওয়া উচিত। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংকট ও সম্ভাবনাকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর প্রথম কাজ যেহেতু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করা তাই ছাত্র রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হবে সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সরব ও সচেষ্ট থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা। যেমন: শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন কিনা, পরীক্ষা দেরিতে হচ্ছে কেন, রেজাল্ট সময়মতো প্রকাশ করছে কিনা, বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য বাজেট বৃদ্ধি ও শিক্ষার মান বৃদ্ধি ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংবলিত বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় কিংবা আদায় না হলে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায় করা।

দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জুনিয়র স্কলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ পর্যায়ে রাজনীতি কাজ করে জুনিয়র স্কলারদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনে। যেমন: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন থাকা ও মত প্রকাশ করা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার জন্য কাজ করা, দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিমুখ চিহ্নিত করা, উন্নয়ন বৈষম্য চিহ্নিত করে পলিসি তৈরি করা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোথায় অবস্থান করছে সেটি আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে। ফলে রাষ্ট্রের জুনিয়র স্কলার তথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় রাজনীতি অন্তরায় নয়, বরং রাষ্ট্রের বৃহৎ এ শ্রেণীর জাতীয় নেতৃত্বের বিকাশে প্রয়োজন ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন