উপকূলীয় তিন জেলায় ডুবে গেছে ১২ হাজারের বেশি মাছের ঘের

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরায় টানা বৃষ্টিতে খাল ও নদীতে মিশে গেছে মাছের ঘের ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি আমন ধানসহ সবজিরও ক্ষতি হয়েছে। খুলনার নয়টি উপজেলার ৬০ শতাংশ মাছের ঘের ডুবে গেছে বলে দাবি করেছে মৎস্য বিভাগ। যদিও এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তারা দিতে পারেনি। মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহের পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। তবে বাগেরহাট মৎস্য বিভাগ বলছে, জেলার সাত হাজার ঘের ডুবে গেছে। সাতক্ষীরায় ডুবে গেছে পাঁচ হাজারের বেশি চিংড়ি ঘের। ডুবে গেছে ৪ হাজার ৬৭৮ হেক্টর আমন ও ৭০০ হেক্টর সবজিখেত।

খুলনা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় সোমবার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় খুলনায় বৃষ্টি হয়েছে ১৫৪ মিলিমিটার। আর টানা তিনদিনে বৃষ্টি হয়েছে ৩২৬ মিলিমিটার। বৃষ্টিতে মাছের পাশাপাশি আমনসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষক।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তিনদিনের বৃষ্টিতে জেলায় ৮৫ হাজার ৬০০ হেক্টর আমন ধানের খেত কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ২ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমির সবজিসহ অন্যান্য ফসল আক্রান্ত হয়েছে। গত এক দশকে খুলনা অঞ্চলে মাছের ঘেরের আইলে সবজি চাষের প্রসার ঘটেছে। সারা বছর এখানে সবজি উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন এখানকার কৃষক। বৃষ্টিতে এসব সবজি গাছের শেকড় ডুবে গেছে। দমকা বাতাসে অনেক গাছের মাচা ভেঙে গেছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়রায় প্রায় ৭০০ মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। চাষীদের মাছ টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, টানা বৃষ্টিতে খুলনার নয়টি উপজেলার ৬০ শতাংশের বেশি মাছের ঘের ডুবে গেছে। বিশেষ করে চিংড়ি ঘেরগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন মাছ তোলার সময়। এ সময় ঘের ডুবে যাওয়ায় মৎস্যচাষীরা লোকসানের মুখে পড়বেন।’

অন্যদিকে বাগেরহাটে শুক্রবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। ডুবে গেছে ঘেরের মাছ। অতিরিক্ত পানিতে একাকার হয়ে গেছে খাল-নদী, মাঠ ‍ও মাছের ঘের। সাত হাজার ঘের ডুবে গিয়ে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ। এবারের বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গলদা চিংড়ি উৎপাদনের অন্যতম এলাকা ফকিরহাট, চিতলমারী ও মোল্লাহাটের চাষীরা। এর সঙ্গে মোংলা, রামপাল ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার চাষীদের ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। চাষীদের দাবি কয়েকশ কোটি টাকার মাছ ডুবে গেছে।

ফকিরহাট উপজেলার ফলতিতা এলাকার কাজী মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে ঘের ডুবে একাকার। ঘেরের পাড়ের ওপর হাঁটুপানি। জাল, কচুরিপানা ও ঘাস দিয়ে মাছ ডুবে যাওয়া ঠেকানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু কত দূর আছে জানি না।’

টাকার অংকে চাষীদের ক্ষতির পরিমাণ না জানাতে পারলেও ক্ষতিগ্রস্তদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম রাসেল। তিনি বলেন, ‘প্রায় প্রতি বছরই বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে ঘেরের মাছ ডুবে যায়। আবার শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে মাছ মারা যায়। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচতে ঘেরের গভীরতা ও পাড়ের উচ্চতা বাড়াতে হবে।’ বৃষ্টির পানি নেমে গেল চুন প্রয়োগ করে পরিমাণমতো খাবার দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বৃষ্টিতে সাতক্ষীরায় চিংড়ি ঘের ও আমন খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৬০০ কোটি টাকার বেশি রফতানিজাত চিংড়ি ডুবে গেছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করতে পারেনি। আইলাদুর্গত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের চিংড়িচাষী আমির হোসেন জানান, তিনদিনের বৃষ্টিতে তার ৫০ বিঘার চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। ডুবে অন্তত ৭-৮ লাখ টাকার মাছ।

একই গ্রামের বেলাল আহমেদের ৬০ বিঘার চিংড়ি ঘের নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। এতে চিংড়ি ও ভেটকিসহ ১০-১২ লাখ টাকার মাছ ডুবে গেছে। শুধু তাদের নয় গাবুরা গ্রামের অন্তত দুই হাজার ঘের ডুবে গেছে।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রইচপুরের মৎস্যচাষী আব্দুল আহাদ জানান, তার ৩০ বিঘার গলদা ও সাদা মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। রইচপুর এবং পাশের পায়রাডাঙ্গা, পরানদাহ ও খানপুর গ্রামের অধিকাংশ ঘের তলিয়ে গেছে। এতে কয়েকশ চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, কয়েকদিনের বৃষ্টিতে ৫ হাজার ১৮১টি চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে ৬৭২ কোটি টাকার রফতানীজাত চিংড়ি। এছাড়া আরো কয়েক কোটি টাকার সাদা মাছও ডুবে গেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, অতিবৃষ্টির কারণে জেলায় ৪ হাজার ৬৭৮ হেক্টর আমন এবং ৬৭৫ হেক্টর খেতের সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব আমন ও সবজি খেত পানিতে ডুবে গেছে। তবে কত টাকার ক্ষতি হয়েছে তা এখন পর্যন্ত নিরূপণ করা যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন