কার্বন ফি কমাতে এশিয়া থেকে ইউরোপগামী শিপিং রুটে নতুন কৌশল

বণিক বার্তা ডেস্ক

নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দর ছবি: রয়টার্স

লোহিত সাগর ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সৃষ্ট রাজনৈতিক এবং সামরিক অস্থিতিশীলতায় গত বছরের শেষ দিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বৈশ্বিক শিপিং কোম্পানিগুলো। বাধ্য হয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনে বিকল্প রুট ব্যবহার করতে থাকে পণ্যবাহী জাহাজ। এরপর থেকে বণিক জাহাজগুলো আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপের মতো দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল পথ পাড়ি দিচ্ছে, যা একই সঙ্গে কার্বন দূষণ বৃদ্ধি করা একটি রুটেও পরিণত হয়েছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ু নীতির বিপরীতে এ রুট জাহাজ মালিকদের দিতে পারে কৌশলগত সুবিধা।

সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছে শিকাগোর কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটিভিত্তিক একটি দল। গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয়েছে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটারস জার্নালে।

গবেষকরা বলছেন, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি শিপিংয়ে দীর্ঘ সময় ও উচ্চ পরিবহন খরচ যোগ করছে। একই সঙ্গে জ্বালানি ব্যবহার বাড়ায়, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ইইউ ফি চালু করলেও এ শিপিং রুট কৌশলগতভাবে সংশ্লিষ্ট উচ্চ খরচ এড়াতে সাহায্য করছে। 

এ বছরের জানুয়ারি থেকে ইমিশনস ট্রেডিং সিস্টেম (ইটিএস) কার্যকর করছে ইইউ। মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যবহার কমাতে উৎসাহ দিতে এ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর অধীনে ক্যাপ-অ্যান্ড-ট্রেড মেকানিজমের মাধ্যমে ইইউর বন্দরে প্রবেশকারী বড় জাহাজ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বাবদ অর্থ নেয়া হচ্ছে। জাহাজগুলো কোথায় নিবন্ধিত বা কোন বন্দর থেকে এসেছে তা বিবেচনা না করেই এক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের বিপরীতে ১০০ ইউরো দিতে হয়। তিন বছরে পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়মটি শিপিং রুটে বড় একটি অংশে বাস্তবায়ন হবে। এর সর্বশেষ ধাপে ইইউর বাইরে শুরু বা শেষ হওয়া সমুদ্রযাত্রা থেকে সব নিঃসরণের ৫০ শতাংশ এবং দুটি ইইউ বন্দরের মধ্যে ঘটে যাওয়া শতভাগ নিঃসরণের ওপর ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে।

এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটারস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় লেখকরা যুক্তি দেন যে সামনে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান ও আইভরি কোস্টের আবিদজানের মতো বন্দর ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে ইইউর নতুন নিয়মে আরোপিত কার্বন ফি থেকে শিপিং কোম্পানির সাশ্রয় হবে।

গবেষকরা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্য বিকল্প রুট শিপিং কোম্পানিকে শুধু লোহিত সাগর এড়াতে সাহায্য করছে না।’ একই সঙ্গে অন্য একটি জাহাজে ইউরোপের উদ্দেশে তাদের পণ্য স্থানান্তরের সুযোগ দেয়। কারণ সর্বশেষ বন্দর থেকে আসা পর্যন্ত নিসৃত কার্বনের ওপর ইটিএস খরচ প্রযোজ্য হবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিঙ্গাপুর থেকে মিসরের সুয়েজ খাল হয়ে নেদারল্যান্ডসের রটারডামমুখী একটি কনটেইনার জাহাজ একক যাত্রায় ১২ হাজার নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করে। এক্ষেত্রে জাহাজ মালিককে পুরো সমুদ্রযাত্রায় কার্বন নিঃসরণের ওপর ৫০ শতাংশ ফি দিতে হবে। এর বদলে সিঙ্গাপুর থেকে একই জাহাজ যদি দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানকে গন্তব্য হিসেবে নেয় তাতে লাভ বেশি। কেননা এরপর রটারডামগামী অন্য জাহাজে কার্গো স্থানান্তর করলে তখন শুধু সাত হাজার নটিক্যাল মাইল ভ্রমণের জন্য অর্থ দিতে হবে।

এ বিষয়ে কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত জিনা কোডি স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্সের পরিবেশগত প্রকৌশল বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থী হি পেং বলেন, ‘লোহিত সাগরের সংকট কার্বন খরচ এড়াতে কার্গো স্থানান্তর ও রুট পুনর্বিন্যাস করার জন্য শিপিং কোম্পানিগুলোকে আরো বিকল্প দিচ্ছে। শিপিং শিল্প কীভাবে কার্বন লিকেজের ঝুঁকি আরো বাড়াতে সাহায্য করছে এ গবেষণা তার দুটি মেরুকে চিহ্নিত করেছে।’

পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মেং ওয়াংয়ের সঙ্গে গবেষণাপত্রটির সহলেখক হিসেবে ছিলেন কনকর্ডিয়ার বিল্ডিং, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক চুনজিয়াং আন। তিনি বলেন, ‘প্রকৌশলী হিসেবে আমরা শুধু কার্বন নিঃসরণের প্রযুক্তিগত অংশ মূল্যায়ন ও এর সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতে পারি। আমরা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারি না। তবে পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন ও কিছু পরামর্শ দিতে পারি, যা আমাদের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করতে পারে।’

গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার পর দৃশ্যপটে নতুন করে আবির্ভূত হয় ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি। পক্ষটি লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কিত জাহাজে হামলার ঘোষণা দেয়। এ সময় পরপর কয়েকটি জাহাজ আক্রান্তও হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশে সাগরে নজরদারি বাড়িয়েও অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রধান শিপিংলাইনগুলো বিকল্প রুট বেছে নেয়, যা সামগ্রিকভাবে শিপিং শিল্পকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। 

সি ইন্টেলিজেন্সের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪ সালে লোহিত সাগর অঞ্চলের গভীর সমুদ্রবন্দরে জাহাজ চলাচল ৮৫ শতাংশ কমে গেছে। অন্যদিকে ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের মতে, লোহিত সাগরে আক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে কনটেইনার শিপগুলো ডিসেম্বর-জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত জাহাজ চলাচল প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। একই সময়ে বিকল্প পথে পণ্য পরিবহনে সময় ও জাহাজ ভাড়া দুই-ই বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন