আমাদের মস্তিষ্ক মেনিনজেস নামক পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। এর মূল কাজ মস্তিষ্ককে যেকোনো আঘাত, সংক্রমণ ইত্যাদি থেকে নিরাপদ রাখা, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখা এবং শর্করাসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু অনেক সময় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে মেনিনজেসে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং তা মস্তিষ্কের আশপাশের কোষেও ছড়িয়ে পড়ে। একে মেনিনজাইটিস বলে। যেকোনো বয়সের মানুষ মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক নানাবিধ জটিলতা দেখা দেয়। তাই মেনিনজাইটিসের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পেলে যত দ্রুত সম্ভব একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
মেনিনজাইটিসের ধরন
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও পরজীবীর সংক্রমণে মেনিনজাইটিস হয়ে থাকে। কখনো কখনো জীবাণুর সংক্রমণ ছাড়াই মেনিনজাইটিস হতে পারে। মেনিনজাইটিসের রয়েছে নানা ধরন। যেমন—
ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিস: মেনিনজাইটিসের সবচেয়ে জটিল ধরন ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এ ধরনের মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতি পাঁচজনে একজন মারাত্মক শারীরিক জটিলতায় ভোগেন। যেসব ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হতে পারে তা হলো স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া, গ্রুপ-বি স্ট্রেপটোকক্কাস, নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস, মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস ও লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনস। নবজাতক থেকে তিন মাস বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে প্রধানত গ্রুপ-বি স্ট্রেপটোকক্কাস ও লিস্টেরিয়া ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হয়। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিসের কারণ নাইসেরিয়া মেনিনজাইটিডিস ও স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া।
ভাইরাল মেনিনজাইটিস : এন্টারোভাইরাসের সংক্রমণ ভাইরাল মেনিনজাইটিসের প্রধান কারণ। এছাড়া আরো কিছু ভাইরাস এ রোগ সৃষ্টি করে যেমন হাম, মাম্পস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, আরবোভাইরাস ও হারপিস ভাইরাস। ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিসের তুলনায় ভাইরাল মেনিনজাইটিস কিছুটা কম ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো তারা দ্রুতই এ ধরনের মেনিনজাইটিস থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে।
ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিস: ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও এইডসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে কোক্সিডায়োডস নামক ফাঙ্গাল বা ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিস হতে দেখা যায়।
পরজীবীঘটিত মেনিনজাইটিস : সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে এ ধরনের মেনিনজাইটিসের জীবাণু ছড়ায়। এটি খুব বিরল ধরনের মেনিনজাইটিস।
লক্ষণ ও উপসর্গ
মেনিনজাইটিসের প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র জ্বর, প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া। এছাড়া আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো—
• বমি বমি ভাব ও বমি
• খাবারে অরুচি
• মেজাজ খিটখিটে থাকা
• আলো সহ্য না হওয়া
• খিঁচুনি
• মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বা স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া
শিশুদের ক্ষেত্রে—
• কিছুতেই কান্না থামানো যায় না
• শিশু খেতে ও ঘুমাতে চায় না
• মাথার তালুতে ফোলা ভাব দেখা যায়
• ঘাড়সহ সারা শরীর শক্ত হয়ে যায়
• হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হয় এবং শিশু অচেতন হয়ে পড়ে
রোগ নির্ণয়: প্রাথমিক পর্যায়ে মেনিনজাইটিস শনাক্তকরণে রক্ত পরীক্ষা করা জরুরি। রক্তে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের উপস্থিতি আছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়। এছাড়া রোগীর মেরুদণ্ডের ভেতরে থাকা কশেরুকা থেকে সিএসএফ (সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড) বা তরল পদার্থ নিয়ে তা পরীক্ষা করা হয়। একে লাম্বার পাংচার বলে।
চিকিৎসা পদ্ধতি: রোগের তীব্রতা ও সংক্রমণের ধরন অনুযায়ী মেনিনজাইটিসের চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম ও স্যালাইন দেয়াসহ কারণ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর সংক্রমণে মেনিনজাইটিস হলে নির্ধারিত অ্যান্টিবায়োটিক ভালো কাজ করে। অন্যদিকে ভাইরাল মেনিনজাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। ক্রিপ্টোকক্কাল বা কোক্সিডায়োডসের মতো ছত্রাকজনিত মেনিনজাইটিসের চিকিৎসায় উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করতে হতে পারে। এছাড়া রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম হলে কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।
মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে করণীয়
মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে নিচের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। যেমন—
• বাইরে থেকে ঘরে ফিরে, খাবার খাওয়ার আগে এবং শৌচাগার ব্যবহারের পরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
• বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
• মাছ, মাংস ও শাকসবজি ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে।
• শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
• ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
• মাথায় কোনো আঘাত পেলে দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
• মেনিনজাইটিসের টিকা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে মেনিনগোকক্কাস ভ্যাকসিন গ্রুপ-এ, সি, ডব্লিউ-১৩৫ এবং ওয়াই টিকা নেয়া জরুরি।
লেখক: চিফ কনসালট্যান্ট, নিউরোলজি বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা