দেশের প্রায় সব ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ছাত্রলীগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি: বণিক বার্তা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর হামলার জেরে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের (১৫ জুলাই) হামলার পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ওপর শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তার পরদিনই অর্থাৎ মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বিকেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলে তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং হল ত্যাগে বাধ্য করেন। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রাত থেকে একে একে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যান শিক্ষার্থীরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ছাত্রলীগ। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে কোণঠাসা হয়ে পড়া সংগঠনটির অনেক নেতা পদত্যাগেরও ঘোষণা দিয়েছেন।      

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কয়টি হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার কক্ষেও ভাঙচুর চালানো হয়। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে প্রায় প্রতিটি হলেই মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন কোটা আন্দোলনকারীরা।

জানা যায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাত ২টার দিকে ঢাবির শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হল, জিয়া হল, মুহসীন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতারা পালিয়ে যান। একপর্যায়ে জহুরুল হক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন প্রভোস্ট। এরপর একে একে মেয়েদের শামসুন নাহার হল, বঙ্গমাতা হল, কুয়েত মৈত্রী হল ও বেগম সুফিয়া কামাল হলও নিয়ন্ত্রণে নেয় সাধারণ ছাত্রীরা। সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয় হল ছাত্র রাজনীতি। 

ঢাবির স্যার এফ রহমান হলও আজ বেলা ১১টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দখলে নেন। এ সময় হলটিতে থাকা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের রুম ভাংচুর করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রলীগ সর্বশেষ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নিয়ন্ত্রণ হারায়। এ হলের ৩৪৩ ও ৩৪৫ নম্বর কক্ষে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও তার অনুসারীরা থাকতেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এ সময় কক্ষ দুটির জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়েছেন ছাত্রলীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী। সোমবার রাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনকারীরা তাদের ধাওয়া দেন। এছাড়া মঙ্গলবার রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ১৯টি কক্ষ দখল করেন শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে দুটি কক্ষে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান থাকতেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: ক্যাম্পাস ছেড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগেরও অধিকাংশ নেতাকর্মী। গতকাল বেলা ৩টার দিকে প্রথম দফায় এবং বিকেল ৫টায় দ্বিতীয় দফায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া করেন আন্দোলনকারীরা। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথম দফায় ধাওয়ার পরপরই রাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বঙ্গবন্ধু হলের সামনে থেকে পুলিশের গাড়িতে করে কয়েকজন নেতাকর্মীসহ ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এরপর বিকেলের দিকে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে দ্বিতীয় দফা ধাওয়া দিলে সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিবসহ বেশিরভাগ নেতাকর্মী ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাইদ নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় বেরোবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ নেতাকর্মীরা দেয়াল টপকে পালিয়ে যান।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিতাড়িত হওয়ার পরপরই আবাসিক হল ছেড়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খলিলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সজিবুর রহমান। বুধবার (১৭ জুলাই) দুপুর ২টা ২০ মিনিটে শাহপরাণ হল থেকে বের হয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসযোগে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন তারা। এ সময় তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের ৫-৭ জন নেতাকর্মীকে দেখা যায়।

ইডেন কলেজ: তোপের মুখে ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা মঙ্গলবার গভীর রাতে বোরকা পরে আবাসিক হল ছেড়ে যান বলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি। এছাড়া ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরাও সকালের মধ্যেই হল ত্যাগ করেন। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আক্রমণের ভয়ে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) রাত ৩টার দিকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পালিয়ে যান। পারবর্তীতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক শিক্ষার্থী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেত্রীরা আমাদের দীর্ঘদিন নানাভাবে নির্যাতন করেছে। আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত সোমবার ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। এতে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পরবর্তীতে মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুনরায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রংপুরে ৬ জন নিহত হন।

এতে শিক্ষার্থীরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এরপর থেকেই দেশের অন্যান্য ক্যাম্পাসগুলোয়ও অধিকাংশ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে বিকেলে শাহবাগে ছাত্রললীগের এক জমায়েতে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে হলে ভাংচুর ও মেয়েদের ওপর নির্যাতনের জবাব ছাত্রলীগ রাজনৈতিকভাবে দেবে। একইসঙ্গে এসব ঘটনায় আইনগত প্রক্রিয়ায় যাতে শাস্তি নিশ্চিত হয় সে লক্ষে কাজ করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন