সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগ

শীর্ষ গ্রেডের পদগুলোয় জনবল অনুমোদনের চেয়ে প্রায় ২২% বেশি

শেখ তৌফিকুর রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

সরকারি দপ্তরগুলোয় অনুমোদিত পদের বিপরীতে জনবল সংকট নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুমোদিত পদের বিপরীতে নিয়োজিত পদের জনবলে বরাবরই দেখা যায় বড় ধরনের ঘাটতি। তবে ব্যতিক্রম দেখা যায় শুধু সর্বোচ্চ পর্যায়ের গ্রেডগুলোর ক্ষেত্রে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মচারী পরিসংখ্যান-২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পাঁচ গ্রেডের জনবল এখন অনুমোদিত পদের চেয়ে প্রায় ২২ শতাংশ বেশি। 

বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা ৫৮। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি দেয়া হয় অনুমোদিত পদ সংখ্যার বিপরীতে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় মূলত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রেডে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তারা গ্রেড-১ ভুক্ত। আর সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের গ্রেড ২০। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রথম থেকে পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত অনুমোদিত পদ সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৯। যদিও এসব পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ২ হাজার ১৩৯ জন। এ অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় শীর্ষ পাঁচ পদে অনুমোদিতের অতিরিক্ত জনবল আছে ৩৮০ জন বা ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। 

এর মধ্যে গ্রেড-১-এ অনুমোদিত পদ আছে ৯০টি। এর বিপরীতে নিয়োজিতের সংখ্যা ১০১। অনুমোদনের অতিরিক্ত কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন ১১ জন। গ্রেড-২-এর আওতায় অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১২৭। কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন ২৬৫ জন। এ অনুযায়ী গ্রেডটির আওতায় অনুমোদনের অতিরিক্ত কর্মকর্তা আছেন ১৩৮ জন। তৃতীয় গ্রেডে অনুমোদনের অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ১৪৮ (অনুমোদিত পদ ৩৭৬টি, নিয়োজিত আছেন ৫২৪ জন)। এছাড়া চতুর্থ গ্রেডে নয়জন (অনুমোদিত ১৪১ জন, কর্মরত ১৫০ জন) ও পঞ্চম গ্রেডে ৭৪ জন (অনুমোদিত পদ ১ হাজার ২৫টি, কর্মরত ১ হাজার ৯৯ জন) অনুমোদনের অতিরিক্ত কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো প্রশাসনে ওপরের দিকে কর্মকর্তার সংখ্যা অনুমোদনের অতিরিক্ত হলে তা হয়ে ওঠে মাথাভারী প্রশাসন। এতে একদিকে যেমন নিচের গ্রেডের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি কর্মসম্পাদনেও পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অসামঞ্জস্যের কারণে প্রশাসন বা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাস্তবায়ন লঙ্ঘন হয়। এটিকে দেখা হয় মাথাভারী ব্যবস্থাপনা হিসেবে। ফলে অনেক দিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় বাড়ে। প্রজাতন্ত্রের জনসেবাসংক্রান্ত প্রাথমিক কাজগুলো করে নিচের স্তরের লোকজন। এমনিতেই সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনবল সংকটের বিষয়টি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। সেখানে অনুমোদিত পদের তুলনায় লোকবল কমের কারণে কর্মসম্পাদনে প্রভাব পড়ে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ওপরের দিকে মাথাভারী হওয়ায় পদোন্নতি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। তখন নিচের গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উচ্চতর পদে পদোন্নতির সম্ভাবনা ক্রমাগত সংকুচিত হয়। ফলে তারা কর্ম উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে এর প্রভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম-প্রতারণা এবং বিভিন্নভাবে প্রভাব সৃষ্টি করার মাধ্যমে প্রমোশন বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টার মতো প্রবণতা বাড়ে। এ কারণে পুরো প্রশাসনে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে যে মৌলিক চাহিদা, সেটি পূরণে ব্যর্থতার পরিচয় পাওয়া যায়।’

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী দপ্তরটিতে দুজন অতিরিক্ত সচিব ও তিনজন যুগ্ম সচিবের পদের অনুমোদন রয়েছে। তবে বর্তমানে সেখানে তিনজন অতিরিক্ত সচিব ও আটজন যুগ্ম সচিব কর্মরত। অর্থাৎ দুটি পদে পাঁচজন জনবলের বিপরীতে অতিরিক্ত আরো ছয়জন কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। 

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী এখানে একজন অতিরিক্ত সচিব ও তিনজন যুগ্ম সচিবের পদের অনুমোদন রয়েছে। তবে বর্তমানে সেখানে তিনজন অতিরিক্ত সচিব ও সাতজন যুগ্ম সচিব কর্মরত। অর্থাৎ দুটি পদে চারজন জনবলের বিপরীতে অতিরিক্ত আরো ছয়জন কর্মকর্তা কর্মরত। 

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী দপ্তরটিতে কোনো অতিরিক্ত সচিবের পদ নেই। তবে দপ্তরটিতে দুজন অতিরিক্ত সচিব কর্মরত রয়েছেন। 

সরকারে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পদগুলোয় এমন অনুমোদনের অতিরিক্ত জনবল দেখা গেলেও উল্টো চিত্র নিচের দিকে। নিচের দিকের গ্রেডগুলোয় জনবলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ জনবলশূন্যতা ক্রমেই বাড়ছে। 

মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় ষষ্ঠ থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত বিদ্যমান পদের সংখ্যা মোট ৩ হাজার ৯২৪। এ চার গ্রেডে কর্মরত ২ হাজার ২৬০ জন। অর্থাৎ এসব গ্রেডে মোট অনুমোদিত জনবলের বিপরীতে ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ৬৬৪ জন। সরকারি চাকরিতে প্রথম থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মরতদের ধরা হয় প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা বলা হয় গ্রেড ১০-১২-এর অধীনে কর্মরতদের। এ তিন গ্রেডে অনুমোদিত পদ সংখ্যা ৪ হাজার ৯৬৭। কর্মরত ৩ হাজার ৩২২ জন। সে অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার ঘাটতি আছে ১ হাজার ৬৪৫ জন। 

তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বলা হয় গ্রেড ১৩ থেকে ১৬-ভুক্তদের। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় এ চার গ্রেডে অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মচারীর ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ১৬৫ জন। 

আর চতুর্থ শ্রেণী বা ১৭-২০ গ্রেডে ৫ হাজার ৭২ জন অনুমোদিত পদ সংখ্যার বিপরীতে কর্মরতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫৪২। এ অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় শেষ চার গ্রেডে জনবল ঘাটতি আছে অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১ হাজার ৫৩০ জন। 

তবে প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শ্রেণীবিন্যাস ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে রহিত করে গ্রেডভিত্তিক শ্রেণীকরণ করা হয়। কাগজে-কলমে এ শ্রেণীভিত্তিক পরিচয় এখন আর নেই। সবার পদমর্যাদা উল্লেখ করা হয় গ্রেডের ভিত্তিতে। যদিও বাস্তবে শ্রেণীভিত্তিক পরিচয়গুলো এখনো হিসাবেই বলা হয়।

নিচের গ্রেডগুলোয় জনবলের ঘাটতি প্রসঙ্গে দি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের আজীবন সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওয়ার্কলোড অনুসারে জনবল নির্ধারণ করতে হয়। ১০ জনের কাজ যদি পাঁচজনে করে তখন ওয়ার্ক লোড বেশি হয়। কাজের গতি কমে যায়। কম লোক থাকায় জনগণেরও ভোগান্তি বাড়ে।’ 

ওপরের গ্রেডগুলোয় অনুমোদনের অতিরিক্ত জনবল প্রসঙ্গে তার ভাষ্য হলো ‘অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক লোক থাকাটা আমাদের প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একটা সমস্যা। প্রমোশনের ব্যাপারটায় অনেকটা লিনিয়ার থাকে সরকার। কারণ অনেককে খুশি করার কারণ থাকে। অনেক সময় দুই-তিন ব্যাচের একসঙ্গে পদোন্নতি হয়। তখন অনুমোদিত পদ থাকে না। সিভিল সার্ভিসের উচ্চ স্তরের কর্মচারীদের খুশি রাখার জন্য অনুমোদিত পদেও অতিরিক্ত প্রমোশন দেয়া হয়। ফলে অনুমোদিত পদ ও প্রকৃত পদে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রমোশন দেয়ার সময় বেশকিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। আমাদের অতিরিক্ত সচিব যে কয়জন প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি রাখতে হয়। কারণ একটা অংশ থাকেন যারা কোনো প্রশিক্ষণ বা বিশেষ কার্যক্রমে যুক্ত থাকেন, কেউ কেউ অসুস্থ থাকেন, আবার আরেকটি অংশকে আমাদের রিজার্ভে রাখতে হয়। বেশি প্রমোশন দেয়ার আরেকটি কারণ অল্প দিনের মধ্যেই কিছুসংখ্যক পিআরএলে চলে যান। আবার বিভিন্ন কারণে অনেকে ওএসডি হন, অনেককে ডেপুটেশনেও দিতে হয়। অনেকে লিয়েন নিয়ে পাঁচ বছরের জন্য দেশের বাইরে চাকরি করেন। নানা রকম বিষয় থাকে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা নবম গ্রেড থেকে ৩০০, ৩৫০ কিংবা ২৫০ জনকে নিয়োগ দিচ্ছি। আমরা চাইলেই ৫০০ জনকে নিয়োগ দিতে পারি না। এত লোক নিয়োগ দিলে অন্যদের প্রমোশনে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কর্মকর্তাদের মধ্যে ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি না হয় সেদিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আগে পদ সৃজন করতে হয়। পিরামিডের মতোই যত ওপরের দিকে যাবে পদের সংখ্যাও ছোট হয়ে আসবে। নিচের দিকে কর্মকর্তা বেশি থাকবে। আমাদের যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই রিক্রুট করতে হবে। আমরা যথাযথভাবে সুন্দরভাবে এগোচ্ছি। আমরা কতজনকে নেব, কতজন দরকার হবে সে ব্যাপারে পরিকল্পনা থাকে। ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের ভিত্তিতেই আমরা যথাযথভাবেই এগোচ্ছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন