৫৮৭ সরকারি কলেজে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট

সংযোগ নেই এক-তৃতীয়াংশ ক্যাম্পাসে, গতিহীন ৪০ শতাংশ

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

চট্টগ্রামের সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ২০২০ সালের দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। চার-পাঁচ মাস অত্যন্ত শক্তিশালী ইন্টারনেট সেবা পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এর পরই বন্ধ হয়ে যায় সংযোগ। বারবার যোগাযোগ করা হয় বিটিসিএলের সঙ্গে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা যাননি এবং সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেননি। বাধ্য হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বেসরকারি ইন্টারনেট সংযোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে কলেজের সদ্যবিদায়ী অধ্যক্ষ প্রফেসর এম নাসিরউদ্দিন মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌যন্ত্রটি এখনো আছে। কিন্তু এটা আর কোনো কাজে লাগে না। নষ্ট হওয়ার পর বলার পরও কেউ আসেনি।’

এদিকে খুলনা কলেজের অবস্থা আরো নাজুক। সেখানে বিটিসিএলের সংযোগ স্থাপন করা হলেও তা কখনো কার্যকর ছিল না। কয়েকবার অভিযোগ জানানোর পর বিটিসিএলের কর্মকর্তারা এসে স্থাপিত বক্স নাড়াচাড়া করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মো. দীন-উল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যন্ত্র স্থাপনের পর তা কখনো কার্যকর ছিল না। তাই আমরা প্রাইভেট সংযোগ ব্যবহার করছি। এখানে বিটিসিএলের টেলিফোন সেবাও বন্ধ রয়েছে।’

রাজশাহী কলেজ, ময়মনসিংহ কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ কিংবা খুলনার সরকারি বিএল কলেজেও বিটিসিএলের সংযোগ অকেজো। দেশের অনেক সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসের চিত্র কম-বেশি এমনই।

দেশের ৫৮৭টি সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের মাধ্যমে ২০২০ সালে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছিল বিটিসিএল। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করার জন্য উদ্যোগটি নেয়া হয়েছিল। এতে ৪৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। কিন্তু পরে রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে হোঁচট খায় ইন্টারনেট সংযোগের প্রকল্পটি। এখন অনেক কলেজেই বিটিসিএলের ইন্টারনেট সংযোগ নেই। যেখানে আছে সেখানেও গতি নেই। কিংবা যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। অভিযোগ করেও এসবের কোনো প্রতিকার মিলছে না বলে অভিযোগ করছেন কলেজসংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি প্রকল্পটির বিষয়ে মনিটরিংয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) একটি সমীক্ষা চালায়। সেখানে বিভিন্ন কলেজে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা এবং গতিহীনতার চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটির সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সাড়ে ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তারা প্রকল্পটির আওতায় ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে না। আর বিদ্যমান ইন্টারনেট সংযোগ বারবার বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই বলে মনে করেন ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এমতাবস্থায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের পক্ষে মতামত দেন। দেশের মোট ৫১টি কলেজের ১ হাজার ৫৩২ জন শিক্ষার্থীর তথ্যের ভিত্তিতে জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

আইএমইডির পক্ষ থেকে পরিদর্শনকালে বেশ কয়েকটি কলেজে সংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে নাটোরের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের পক্ষ থেকে গতি কম হওয়ায় বিটিসিএলের ইন্টারনেট ব্যবহার উপযোগী নয় বলে অভিযোগ করা হয়। রাজশাহী কলেজ কর্তৃপক্ষের মতে, ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ২০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে। যা শিক্ষার্থীর তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আবার সবসময় এ গতি পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০০ এমবিপিএস গতির সংযোগ নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে এসেছে।

সরকারের প্রযুক্তি অবকাঠামো সম্প্রসারণের ভালো উদ্যোগগুলো রক্ষণাবেক্ষণ এবং গ্রাহকসেবা নিশ্চিত না করায় মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের প্রযুক্তি প্রসারের উদ্যোগুলো ভালো। কিন্তু অবকাঠামোর পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলো অনেক সময় প্রকল্পে যুক্ত থাকে না। উৎসাহমূলক কোনো ব্যবস্থাও হয়তো থাকে না। যথাযথ মনিটরিং না থাকায় গ্রাহকসেবাও নিশ্চিত করা যায় না। ফলে মানুষ সেবা না পেয়ে বেসরকারি সেবার প্রতি ঝুঁকে পড়ে।’

তবে এসব যন্ত্রপাতি ঠিক করা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বলে জানিয়েছেন বিটিসিএল কর্মকর্তারা। প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. আমিনুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সারা জীবন বিনা পয়সায় সার্ভিস দেয়া সম্ভব না। যন্ত্রপাতি খারাপ হয়ে গেলে তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্রয় করবে। শুধু কেবল নষ্ট হলে বিটিসিএল তা সরবরাহ করবে। আর এসব দেখার জন্য জেলা পর্যায়ে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রয়েছেন, তারা দেখবেন। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে এটা দেখা হয় না।’

প্রকল্পের যন্ত্রপাতি তিন-চার মাস পর নষ্ট হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পণ্যের গুণগত মানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এত অল্প সময়ে নষ্ট হওয়ার কথা না। শিক্ষকরা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেন এসব।’

আইএমইডির প্রতিবেদনেও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান জানেও না যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তাদেরই কিনতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা মাঠের পরিস্থিতি তুলে আনার চেষ্টা করেছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়েই আমরা কাজটা করে থাকি। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পে যেন বিদ্যমান পরিস্থিতির মতো কোনো গ্যাপ না থাকে, সেজন্য আমরা কাজগুলো করে থাকি। বিষয়গুলো আমরা নিবিড়ভাবে দেখার চেষ্টা করি। তাছাড়া আমাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকল্পে কারো গাফিলতি থাকলেও ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন