সেমিতে ওঠার সুযোগ হারাল বাংলাদেশ

বিশ্বকাপে আফগান রূপকথা চলছেই

ক্রীড়া প্রতিবেদক

রিশাদ হোসেনকে বোল্ড করে আনন্দ বাঁধ ভাঙে আফগান দলনায়ক রশিদ খানের। ৪ উইকেট নিয়ে দলের জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি ছবি: এপি
Default Image

ক্রিকেটের ‘যাযাবর’ রশিদ খান, মোহাম্মদ নবি, গুলবাদিন নায়েবরা। নিজেদের আন্তর্জাতিক মানের কোনো মাঠ নেই। ২০০৯ থেকে ওয়ানডে ও ২০১০ থেকে টি-টোয়েন্টি খেললেও কখনো নিজ দেশে খেলার সৌভাগ্য হয়নি তাদের। ‘হোম ম্যাচ’ কী, সে অনুভূতি কখনো পায়নি আফগানরা। কখনো দুবাই, কখনো আবুধাবি, কখনো শারজাহ, কখনো বা ভারতের লক্ষ্ণৌ, দেরাদুন ও নয়ডায় নিজেদের ‘হোম ম্যাচ’ খেলে তারা। এতসব বাধাবিপত্তির পরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাদের অর্জন ঈর্ষণীয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির বিদেশ বিভুঁইয়ে ক্রিকেট দলটি মাঝেমধ্যেই জানিয়ে দেয়, তারা ক্রিকেটে ইতিহাস গড়তে এসেছে। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে নবম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে ইতিহাস রচনা করল জোনাথন ট্রটের শিষ্যরা।

গতকাল সেন্ট ভিনসেন্টে সুপার এইটের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে ডিএলএস মেথডে ৮ রানে হারিয়ে ভারত, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার পর চতুর্থ দল হিসেবে শেষ চারে উঠে এলিটদের কাতারে নিজেদের নামটি লিখিয়ে নিল আফগানিস্তান। যেকোনো বৈশ্বিক আসরেই এটা তাদের প্রথম সেমিফাইনাল। রূপকথা লিখে চলা রশিদ খান, গুলবাদিন নায়েবরা কি এবার ফাইনালের স্বপ্নও দেখছেন?

অগামীকাল সকাল সাড়ে ৬টায় ত্রিনিদাদে প্রথম সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে আফগানরা। একই দিন রাত সাড়ে ৮টায় গায়ানায় দ্বিতীয় সেমিফাইনালে লড়বে ইংল্যান্ড ও ভারত। শনিবার রাতে বার্বাডোজে ফাইনালের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আসরের।

গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচের ৪টি জিতে চমক দেখায় আফগানরা। হারিয়ে দেয় ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেদারল্যান্ডসকে। যদিও অল্পের জন্য সেমিফাইনালে যেতে পারেনি তারা। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও শুরু থেকে চমক দেখাতে থাকে রশিদের দল। গ্রুপ পর্বে হারিয়ে দেয় নিউজিল্যান্ডের মতো পরাশক্তিকে। সেই হারেই এবার বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় কিউইদের। আফগানদের সেই জয়টি যে কোনোভাবেই অঘটন ছিল না তা প্রমাণ করল সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়ার মতো আরেক পরাশক্তিকে হারিয়ে। তাতে খুলে যায় সেমিফাইনালে ওঠার দুয়ারও। গতকাল বাংলাদেশ দলকে হতাশার সাগরে ভাসিয়ে তারা উঠে গেল সেমিফাইনালে।

সুযোগটা আকস্মিকভাবেই এসেছিল বাংলাদেশের সামনে। দুর্দান্ত বোলিং প্রদর্শনীতে আফগানিস্তানকে ১১৫ রানে আটকে দেন রিশাদ হোসেন (৩/২৬), তাসকিন আহমেদ (১/১২) ও মুস্তাফিজুর রহমানরা (১/১৭)। চার ওভারে ১৯ রান দিয়ে সাকিব আল হাসানও কৃতিত্বের দাবিদার। এতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়। তবে সেই সুযোগ লুফে নিতে ব্যর্থ হলেন শান্ত ও তার সতীর্থরা। 

ইতিহাস গড়তে ১২.১ ওভারে ১১৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে হতো বাংলাদেশকে। এ চ্যালেঞ্জে ব্যর্থ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের দল। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ৪৩ রান তুলতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। ১১ ওভার শেষে সংগ্রহ দাঁড়ায় ৮০/৭। স্বপ্নের সলিল সমাধিও সেখানেই হয়ে যায়। এরপর তিন বোলার তানজিম হাসান সাকিব, তাসকিন ও মুস্তাফিজকে নিয়ে ১০৫ রান পর্যন্ত যেতে পেরেছে বাংলাদেশ। 

১২.১ ওভারের মধ্যে না পারলে জিতেও কোনো লাভ হতো না। রানরেটে অস্ট্রেলিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারত না টাইগাররা। কিন্তু সেই সমীকরণে যাওয়াই লাগেনি। পেস বোলার নবীন-উল-হকের বুক চিতিয়ে করা লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসল আফগানরা। তীরে এসে তরী ডুবল শান্তদের।

১১৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারেই নবীন-উল-হককে চার-ছক্কা হাঁকিয়ে শুরু করেন লিটন দাস। তবে পরের ওভারেই ফজলহক ফারুকিকে উইকেট দিয়েছেন তানজিদ হাসান তামিম। ফারুকির গুড লেংথের বল ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন তিনি। ৩ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি এ বামহাতি ব্যাটার। তিনে নেমে সুবিধা করতে পারেননি দলনায়ক শান্ত। উইকেটে এসেই বড় শট খেলার চেষ্টা করেন। তৃতীয় ওভারে নবীনকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ধরা পড়েন নবির হাতে। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৫ বলে ৫ রান।

পরের বলেই সাকিবকেও (০) ফিরিয়েছেন নবীন। একাদশে ফেরা সৌম্য ভালো শুরু পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেননি। ১০ বল খেলে করেছেন ১০ রান। অনেকের চোখেই আগামীর বড় তারকা তাওহীদ হৃদয় (৯ বলে ১৪) যতক্ষণ ছিলেন আশাও টিকে থাকে। যদিও নবম ওভারে রশিদের বলে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন ইব্রাহিম জাদরানকে। ১১তম ওভারের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বলে মাহমুদউল্লাহ ও রিশাদ হোসেনকে পরপর আউট করে আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন স্পিন জাদুকর রশিদ খান। লিটন (৪৯ বলে ৫৪*) এক প্রান্ত আগলে রাখলেও অন্য প্রান্তে নিয়মিত উইকেট পতন ঘটাচ্ছিলেন রশিদ (৪/২৩)।

বাংলাদেশের যখন ৯ বলে ৯ রান প্রয়োজন তখন পরপর দুটি গোলায় তাসকিন আহমেদ ও মুস্তাফিজুর রহমানকে আউট করে আফগানদের জন্য রূপকথা লিখে ফেলেন নবীন-উল-হক। (৪/২৬)। 

৭৩ বলে ১১৬ রান করে সেমিফাইনালে ওঠার ভালো সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। সেই সম্ভাবনা যখন ক্ষীণ হয়ে আসে, তখনো অন্তত জয় পাওয়ার সুযোগ ছিল। কারণ লক্ষ্যটা ছোট। যদিও শেষ পর্যন্ত জয়টিও পাওয়া হলো না লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। 

সেমিতে ওঠার হাতছানি এবং পরে জয় হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দলনায়ক শান্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘পরিকল্পনাটা এমন ছিল যে আমরা প্রথম ৬ ওভার চেষ্টা করব। পরিকল্পনা ছিল, যদি আমরা ভালো শুরু করি, দ্রুত উইকেট যদি না পড়ে, তাহলে আমরা সুযোগটা নেব। কিন্তু যখন আমাদের দ্রুত ৩ উইকেট পড়ে গেল, তখন আমাদের পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল, যেন আমরা ম্যাচটা জিততে পারি। তার পরও আমি বলব, মিডল অর্ডার ভালো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যার কারণে ম্যাচটা আমরা হেরে গেছি।’

দুই দলের সামনেই হাতছানি ছিল প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়ার। এ রেসে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে আফগানরা ইতিহাস লিখল। আর কখনই সেমিফাইনাল না খেলার আক্ষেপ নিয়ে দেশে ফিরবেন সাকিব-শান্তরা। দারুণ সম্ভাবনার পরও এমন বিদায়ে দেশের ক্রিকেটে এখন শোক। টাইগার সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে শান্ত বলেছেন, ‘পুরো টুর্নামেন্ট নিয়ে আমি বলব, আমরা সবাইকে হতাশ করেছি। আমাদের খেলা যারা অনুসরণ করেন, যারা আমাদের সব সময় সমর্থন করেন, তাদের আমরা হতাশ করেছি। পুরো দলের পক্ষ থেকে আমি তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইছি।’

সংক্ষিপ্ত স্কোর

আফগানিস্তান: ২০ ওভারে ১১৫/৫। বাংলাদেশ: ১৭.৫ ওভারে ১০৫/১০। ফল: আফগানিস্তান ৮ রানে জয়ী (ডিএলএস মেথডে)। প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ: নবীন-উল-হক (আফগানিস্তান)। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন