বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজ এলাচ তেজপাতার দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে মসলার চাহিদা বাড়ে। প্রতি বছর ঈদের এক-দুই মাস আগে বাড়তে শুরু করে মসলার দাম। এ বছরও মাসখানেক আগে থেকে মসলাপণ্যের দাম বেড়েছে। দামের এ ঊর্ধ্বগতি এখনো চলমান। গত এক বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজ, এলাচ ও তেজপাতার দাম বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। রসুন ও হলুদের দামও ৫০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এছাড়া আদা, দারচিনি ও ধনিয়ার দামসহ বিভিন্ন মসলাজাতীয় পণ্যের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার এবং বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে এ চিত্র উঠে এসেছে।

টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে দেশে মসলাজাতীয় পণ্যের দাম ১০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০-৩০ টাকা। রসুনের দাম ১০-২০ টাকা, বিদেশী শুকনা মরিচের দাম ২০, আদার দাম ৪০ থেকে ৭০, জিরার দাম ১০০, এলাচের দাম ৩০০-৪০০ টাকা বেড়েছে।

আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে মসলার বার্ষিক বাজার এখন ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। তবে এসব পণ্যের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি, ঋণপত্র জটিলতার কারণে সঠিক সময়ে আমদানি করতে ব্যবসায়ীদের বেগ পেতে হচ্ছে। যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু মসলার দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেও তা বেড়েছে। এছাড়া ঈদুল ফিতরের পর থেকে বাজারে মসলাপণ্যের দাম বাড়ছে।

দেশে চাহিদার দিক থেকে প্রধান মসলার মধ্যে রয়েছে জিরা, দারচিনি, এলাচ, গোলমরিচ, তেজপাতা, লবঙ্গ, শুকনা আস্ত মরিচ, শুকনা আস্ত হলুদ, সরিষা ও ধনিয়া। মসলার মধ্যে দ্বিতীয় সারিতে রয়েছে মেথি, কালিজিরা ও মিষ্টি জিরা। এছাড়া জায়ফল, জয়ত্রি, রাঁধুনি, স্টার ফুল, শাহি জিরা, সাদা গোলমরিচের ব্যবহারও হয় উৎসব-পার্বণে। এসব মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে সরিষা, কালিজিরা, মিষ্টি জিরা, তেজপাতা, মরিচ, হলুদ ও ধনিয়া দেশে উৎপাদন হলেও বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করে দেশীয় চাহিদা মেটাতে হয়।

তাছাড়া জিরা, দারচিনি, এলাচ, গোলমরিচ, লবঙ্গ, জায়ফল, জয়ত্রি, শাহি জিরা, সাদা গোলমরিচ, মেথি, রাঁধুনি, স্টার ফুলসহ বেশ কয়েক ধরনের মসলার প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে পচনশীল মসলার মধ্যে পেঁয়াজ, আদা ও রসুন দেশে উৎপাদিত হলেও বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভশীলতা রয়েছে অনেকাংশে। যে কারণে দেশে বাড়তি চাহিদার মৌসুমগুলোয় এসব পণ্যের দাম চড়া থাকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মসলার দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে এক বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আমদানি করা পেঁয়াজ, তেজপাতা ও এলাচের। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। যদিও টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে আমদানি করা পেঁয়াজের বর্তমান দর ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। এক বছর আগে একই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৮৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

মাংস রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকায়। টিসিবির মূল্য তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে এলাচের বাজার দর ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা। এক বছর আগে এলাচ বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এলাচের দাম বেড়েছে ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে তেজপাতার দামও বেড়েছে ৮৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। বর্তমানে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় তেজপাতা পেলেও এক বছর আগে তা ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, মসলাপণ্যের মধ্যে বর্তমানে প্রতি কেজি লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়। গত কোরবানির আগে এর দাম কেজিপ্রতি ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা ছিল। ধনিয়ার কেজি এখন ২৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। বছরখানেক আগে যা ছিল ২০০ থেকে ২২০ টাকা। এছাড়া জয়ত্রি ৪ হাজার টাকা, জায়ফল দেড় হাজার টাকা, কাজুবাদাম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা ও কাঠবাদাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক মাসের ব্যবধানে এই পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে।

জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের মেসার্স নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপক অমল সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌মসলার বাজার কোরবানির ঈদের আগে চাঙা থাকে। কিন্তু এ বছর মসলা আমদানি আশানুরূপ না হওয়ায় বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ ডলারের বিনিময় হার বাড়ার প্রভাব পড়েছে আমদানি হওয়া মসলার দামে।’

জানতে চাইলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গুলিস্তান ফিডের স্বত্বাধিকারী মো. ওমর ফারুক জানান, বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় কয়েকটি মসলা উৎপাদন হলেও চাহিদার তুলনায় সেগুলো অনেক কম। তাছাড়া দেশীয় আবহাওয়ায় প্রয়োজনীয় অনেক মসলার উৎপাদন সম্ভব নয়। যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উৎপাদন, সরবরাহ ও দামের ওপর দেশের বাজার নির্ভর করে। বিশ্ববাজারে মসলাপণ্যের দাম তেমন একটা না বাড়লেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাজার অস্থিরতায় ভুগছে। কোরবানির ঈদের পর চাহিদা কমলে বাজার আবার স্থিতিশীলতায় ফিরতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।

টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি মূল্য কিছুটা বেড়েছে জানিয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মুনাফার প্রতি লোভ বেড়েছে। ভোক্তাদের আরো সচেতন হতে হবে এবং দরাদরি করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমরা এখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আছি। জোর-জবরদস্তি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের সৎ হতে হবে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরো)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন