অভিমত

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মো. শফিকুল আলম, আরিফুল ইসলাম ভুঁইয়া

ছবি : বণিক বার্তা

গত ১০-১২ বছর ধরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আলোচনা করেও কার্যকর কোনো অগ্রগতি লাভ করেনি। এছাড়া বিভিন্ন ব্লকের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের কিংবা পক্ষের সঙ্গেই এফটিএ চুক্তি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি (ভুটান ব্যতীত)। অন্যদিকে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে বর্তমান সুবিধাপ্রাপ্ত শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধাগুলো বাতিল হয়ে যাবে। একই সঙ্গে রফতানির বিপরীতে প্রণোদনা ও নগদ সহায়তাও বন্ধ করে দিতে হবে সরকারকে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়বে দেশের রফতানি বাণিজ্য।

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছরে রফতানি আয় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়ে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে উত্তীর্ণ হয়েছে, যার অধিকাংশ অবদান রফতানি পোশাক শিল্পের। পোশাক রফতানি খাতের একচেটিয়া বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো। উল্লেখ্য বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইইউ দেশগুলোর কাছ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে থাকে। বাংলাদেশ বর্তমানে মোট রফতানির ৭৩ শতাংশের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। জিএসপি অন্তর্ভুক্ত তিনটি সুবিধার মধ্যে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে এভরিথিং বাট আর্মসের (ইবিএ) আওতায়। অবশিষ্ট দুটি সুবিধা হলো জিএসপি প্লাস এবং জিএসপি স্ট্যান্ডার্ড। বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্রুপ-৩-এর আওতায় (গ্রুপ-৩ দেশগুলো হলো: বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকা) জিএসপি সুবিধা গ্রহণ করে আসছে। 

দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধার ওপর নির্ভর না করে ২০২৬ সালের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিবেশী ছোট অর্থনীতির দেশ ভুটানের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে পিটিএ বা এফটিএ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে এফটিএ আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৭টি দেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, চিলি, চীন, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তানসহ ৫০টির মতো দেশের। মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিযোগীদের থেকে অনেক দূর পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনাম ছাড়াও কম্বোডিয়ার সঙ্গে আছে নয়টি দেশের, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ১৭টি দেশের, ভারতের সঙ্গে ১৫টি দেশের, মালয়েশিয়ার সঙ্গে ১৯টি দেশ, জাপানের সঙ্গে ২০টি দেশ, চীনের সঙ্গে ২২টি দেশ এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২৭টি দেশের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি কার্যকর রয়েছে। 

২০২০ সালে ভুটান ও বাংলাদেশের ভেতর যে প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (প্রিফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষর হলেও সফল বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বর্ণিত চুক্তির আওতায় ভুটানের ৩৪টি পণ্য এবং বাংলাদেশের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশ ২৩টি দেশের সঙ্গে মুক্ত বা প্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য বাংলাদেশ এরই মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করেছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে। মুক্ত বা প্রাধিকারমূলক বাণিজ্যচুক্তি যেসব দেশের সঙ্গে অগ্রগতি হয়েছে, তা হলো চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে এবং ইউরেশিয়ান কাস্টমস ইউনিয়ন। তবে ভারতের সঙ্গে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সিইপিএ) করার কথা আছে যা কানাডার সঙ্গেও মুক্তবাণিজ্য (সিইপিএ) চুক্তি হতে পারে মর্মে বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জানা গেছে। চীনের সঙ্গে এফটিএ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক পা এগোয় তো দুই পা পিছিয়ে যায়। কারণ বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের একটি বিরাট অংশ আসে আমদানি খাত থেকে। এফটিএ স্বাক্ষর করা হয় পারস্পরিক সমঝোতায় আমদানি-রফতানি উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই উপলব্ধি করতে হবে যে রক্ষণশীল অবস্থান নিলে কোনো এফটিও করা যাবে না বা করলেও সুবিধা পাওয়া যাবে না। কারণ বাংলাদেশ শুল্ক ছাড় না দিলে অন্য পক্ষের কাছ থেকেও ছাড় পাওয়া যাবে না। 

তাছাড়া ডব্লিউটিওর বিধি অনুসারে চুক্তি সম্পাদনের পর একটি যুক্তিসংগত সময়সীমার মধ্যে যেকোনো মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল বা শুল্কসংঘ বাস্তবায়ন করতে হয় (গ্যাট অনুচ্ছেদ ২৪, ধারা ৫-সি)। আর এ সময়সীমা ১০ বছরের বেশি হলে তা ব্যতিক্রম ধরা হয়, যার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আবার ডব্লিউটিওকে অবহিত করতে হয়। মোদ্দা কথা, একবারে নয় বরং ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত পণ্যের আওতা বাড়াতে হয়।

অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (ইপিএ) বাস্তবায়ন হলে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন হবে, যা দুদেশের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। ইপিএ চুক্তির ফলে প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশ পরবর্তী বিনিয়োগে নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হয়ে উঠবে আশা করা যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, উভয় দেশে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রায় ৮৫ শতাংশ বাংলাদেশী ও জাপানি প্রতিষ্ঠান চায় তাদের নিজ নিজ সরকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করুক। চুক্তির আওতায় যাতে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশের শুল্ক সুবিধা অব্যাহত থাকে। অন্যথায় জাপানের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা অন্যান্য দেশের পণ্যের কাছে বাংলাদেশী পণ্য প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে। 

চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে এ পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক এফটিএ চূড়ান্ত হয়নি। উভয় দেশই বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে এবং ভবিষ্যতে একটি এফটিএ প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এফটিএ সই করার বিষয়ে যৌথভাবে খসড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় করেছে দুই দেশ। গত কয়েক বছরে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে এফটিএর সম্ভাব্যতা নিয়ে একাধিক দফা আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্যের বৃদ্ধি, শুল্ক কমানো এবং উভয় দেশের পণ্যের জন্য বাজার সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। বাণিজ্য ছাড়াও বাংলাদেশে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে অবকাঠামো প্রকল্পসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক ফ্রন্টে চীন সহযোগিতা করছে। চীন বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ কানেকটিভিটি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। যদিও একটি আনুষ্ঠানিক এফটিএ এখনো আলোচনার টেবিলে রয়েছে, এছাড়া একটি সাফল্যজনক অর্থনৈতিক চুক্তি বা এফটিএ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বাণিজ্যের দিকে উভয় দেশ ধাবিত হতে পারবে।

ভারত আমাদের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও এখন পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি। তবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সাফটা চুক্তি বলবৎ রয়েছে। যদিও ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক বাধা নেই, তথাপি বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক বাধা রয়েছে; যার মধ্যে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ, পণ্যের গুণগত মান-সংক্রান্ত সার্টিফিকেশন, বন্দরের অপ্রতুল অবকাঠামো, স্থল ও নৌপথে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ভারতের সঙ্গে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (সিইপিএ) সমীক্ষার বাংলাদেশ অংশের প্রাথমিক আলোচনা শেষ হয়েছে। সমীক্ষার তিনটি অংশ হলো পণ্য বাণিজ্য, সেবা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। সেবা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে এর আগে আলোচনা হয়েছে। আর পণ্য বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার হওয়ায় দেশটির সঙ্গে আমাদের দ্রুত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক চুক্তি বাস্তবায়ন করা জরুরি ।

যদিও বাংলাদেশর রফতানি বাণিজ্যের মূল গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পণ্য রফতানির ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়ে থাকে (সূত্র: এডিবি)। সেক্ষেত্রে আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ সম্পাদনে দ্রুত নজর দিতে হবে। অন্যথায় রফতানি বাণিজ্য যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে তা দেশী রফতানিকারক, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানিকারকরা অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাবে। বাংলাদেশের সক্ষমতায় দেশী রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যে পিছিয়ে পড়বে তা অবশ্যম্ভাবী। কারণ জিএসপির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পোশাক রফতানিতে শুল্ক বাড়বে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত যা দেশীয় রফতানিকারকদের জন্য অনেক বড় চ্যলেঞ্জ হয়ে উঠবে।

যেহেতু বাংলাদেশের পণ্য রফতানির ৭৬ শতাংশ হয়ে থাকে ১২টি দেশে, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, ভারত, জাপান, পোল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। এসব দেশের সঙ্গে এফটিএ করলে বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে লাভবান হবে। আমাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সক্ষমতা বিবেচনায় ২০২৬ সালকে মাথায় রেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এর সফল বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

মো. শফিকুল আলম: ম্যানেজিং পার্টনার ও সিইও, শফিকুল আলম অ্যান্ড কো. চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস

আরিফুল ইসলাম ভুঁইয়া: উপপরিচালক, বেপজা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন