মূল্যস্ফীতি

বাড়তি দামের অভিঘাত থেকে স্বল্প আয়ের মানুষকে রক্ষা করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে ৬ জুন। পরদিন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়। প্রস্তাবিত বাজেট ও বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মলনে অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে আসন্ন অর্থবছরে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ওপর যেন কোনো চাপ না পড়ে, সেজন্য বাজেটের আকার ছোট রাখা হয়েছে; বছরের শেষের দিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। 

বাজেট প্রস্তাব ও বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মলনে বলা এসব কথায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের বিভিন্ন সংস্থা। সংস্থাগুলোর মতে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং বাড়িয়ে দেবে।  নতুন করে বেশকিছু খাতে আরো ভ্যাট আরোপ এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে উল্লেখ করে তারা। তাদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিদ্যমান নানা সংকটের সময়ে এমন একটি বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে যেখানে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বারোপ করা হয়নি। 

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টদেরও মতে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভবপর নয়। কারণ বাজেট সংকোচনমূলক হলেও আর্থিক খাত সংস্কার, বাজার ব্যবস্থাপনার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই বাজেটে। এছাড়া বৈষম্যমূলক রাজস্বনীতি মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াবে। 

দেশ দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত বিভিন্ন সমস্যায় নিপতিত। মানুষের অনাস্থা ব্যাংক খাতের প্রতি, তারল্য সংকট, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, মন্দ ঋণ প্রভৃতি সমস্যায় আছে ব্যাংক খাত। দেশের বাজারের দিকে তাকালে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা আছে। অতি মুনাফার আশায় অসৎ ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করে দ্রব্য, স্বেচ্ছাচারী হয়ে দাম বাড়িয়ে দেয়। সরকার বাজারদর বেঁধে দিয়ে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযানে নামিয়েও পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বেড়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি। এছাড়া রয়েছে অর্থ পাচার, ডলার সংকট ও রিজার্ভ ক্ষয়, অতিরিক্ত পরোক্ষ করের মতো বিবিধ চ্যালেঞ্জ। এসব কিছুর প্রভাব পড়ছে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায়। তাদের ভোগ কমছে দিনকে দিন। বাড়তি দামের এ অভিঘাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হলে আর্থিক খাত সংস্কার, বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্বনীতি দরকার। অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।

এবারের বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-বহির্ভূত খাত থেকে আসবে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ বাজেটে কর-জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে। যদিও প্রত্যক্ষ করজালের পরিধি বিস্তৃত করা হয়নি। বাড়ানো হয়েছে ভ্যাট। ভ্যাট নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ কর প্রদানের সমান। এতে সমাজের উচ্চবিত্তদের জীবনে কোনো প্রভাব পড়ে না। যদিও নিত্যপণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। তবে সেটি যে কাজ করবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যানমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অংকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ কেবল পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রফতানিতে কম দাম দেখানোর মাধ্যমে এ পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই সময়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, আমদানি শুল্ক কমানোর কতটা কার্যকর প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়বে। যেখানে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমানো সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে কেবল শুল্ক মুক্ত করলেই দাম কি সহানীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে! এ নিয়ে বাজেটে যে পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। উল্টো কালো টাকা সাদা করার যে উপায় দেখানো হয়েছে তা দেশের দুর্নীতি বাড়াতে আরো সহায়ক হবে। একজন বৈধ আয়কারী ব্যক্তি কেন দ্বিগুণ কর (৩০ শতাংশ) দিতে যাবে যদি বিনা প্রশ্নে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে আসন্ন অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যায়? এমন অন্যায্য করা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে রাজস্ব প্রবাহ কমবে বৈ বাড়বে না। তবে সংসদ সদস্যের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ রহিত করা এক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আসন্ন অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নির্বাহের জন্য প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরেও সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়বে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে একটা বড় পরিমাণ নেয়া হবে ব্যাংক ও বেসরকারি খাত থেকে। এটি বেসরকারি খাতগুলোর জন্য ঝুঁকিস্বরূপ। বেসরকারি খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। ঘাটতি বাজেট নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়াবে। উপরন্তু ব্যাংক খাত সংস্কারের কোনো কথা বলা হয়নি। 

দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। মূল্য স্তর স্ফীত হয়ে দুই অংকের ঘরে পৌঁছেছে। সে অনুপাতে বাড়েনি মানুষের আয়। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে দেশের আর্থিক খাত সংস্কারের বিকল্প নেই। আসন্ন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন