সিপিডির প্রতিক্রিয়া

মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে প্রস্তাবিত বাজেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সিপিডির সংবাদ সম্মেলন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের বদলে আরো উসকে দেবে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। নতুন করে বেশকিছু খাতে আরো ভ্যাট আরোপ এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। সংকটের সময়ে একটি সাধারণ বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বাজেট পর্যালোচনায় এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। এতে বাজটের ওপর বিভিন্ন খাতভিত্তিক সুপারিশও তুলে ধরা হয়।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নতুন বাজেট প্রস্তাবের মাধ্যমে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিভিন্ন খাতে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বছরে চারবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ককে যে ছাড় দেয়া হয়েছে, তা আমদানিকারকদের পকেটে ঢুকে যাবে। এটা থেকে খুব বেশি সুফল আসবে না। ফলে প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বদলে এটা আরো উসকে দেবে। আর সরকারের রাজস্বনীতি কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীনির্ভর হয়ে পড়েছে।’

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘‌মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজেটে গৃহীত পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে এককভাবে এটা কমানো যাবে না। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের নির্দেশনা নেই। আর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব কর ফাঁকিকে উৎসাহিত করবে। তাছাড়া এ প্রস্তাব নিয়মিত করদাতাদের তিরস্কৃত করছে। এটা কোন ধরনের সামাজিক ন্যায্যতা? নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্কারোপে উদারতা না দেখালে আইন পরিবর্তন হবে না।’

অনেক স্বল্পোন্নত দেশে মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন ফাহমিদা খাতুন। বাজেট পর্যালোচনায় তিনি বলেন, ‘‌স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বরাবরই জিডিপির আকারের ১ শতাংশের নিচে রয়ে যায়। সেভাবে দেখতে গেলে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গড়ে দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৫ অর্থবছরে সেটি কমে দশমিক ৭ শতাংশ। এত বড় জনগোষ্ঠীর জন্য এ সামান্য অর্থ কতটুকু কী সুবিধা দেবে, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।’

অন্যান্য বছরের মতো এবারো জিডিপির আকারে শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৬-এর সংশোধিত বাজেটে যেটা ছিল ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, সেটা ২০২৫ সালে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে গত বছরের তুলনায় বাজেটের আকার এবার কিছুটা বেড়েছে। প্রায় ৩৮টি স্বল্পোন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ২০১৬ সাল থেকে আমরা তৃতীয় নিম্নতম দেশ, যেখানে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কম হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যার একটি বড়সংখ্যক যুবক। যুব বেকারত্ব দূর করার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’

জ্বালানি খাতের বাজেট নিয়ে তিনি বলেন, ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দে বিদ্যুৎ খাতে ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন প্রকল্পে কিছুটা কমানো হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এখানে ট্রান্সমিশনে ২৭ শতাংশ ও ডিস্ট্রিবিউশনে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি, যা উৎপাদনকে বৃদ্ধি করবে। জ্বালানি খাতেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। ২০২৪ সালের তুলনায় তা ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা ২০২৫ অর্থবছরের বাজেটের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।’

পরিবেশ সম্পর্কিত বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‌পরিবেশ নিয়ে এবার বরাদ্দ ২০২৪-এর তুলনায় কমেছে। এখানে বিভিন্ন খাতওয়ারি বরাদ্দে একটি স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বিপিসি ও পেট্রোবাংলায় তাদের এডিপি বরাদ্দের মধ্যে বড় একটি অংশই বিদেশী বরাদ্দ। যেখানে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ বিপিসির জন্য। অন্যদিকে ৪৯ শতাংশ পেট্রোবাংলার জন্য। এর পাশাপাশি পরিবহন ও যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়ে থাকে। এছাড়া জেন্ডার বাজেটের বরাদ্দ ২০২৫-এ সামান্য বেড়েছে। কিন্তু জেন্ডার বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এখানে ব্যয় কীভাবে, কতখানি হলো সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।’

সিপিডির মূল বক্তব্য তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘‌চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে জনগণকে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগণের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দসহ বিভিন্ন কর সুবিধা দিয়ে এটি করা যেতে পারে। এখানে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ দিয়ে এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর পাশাপাশি সহায়ক রাজস্বনীতি নেয়া না হলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো দুরূহ হবে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষ্যমাত্রা দেয়া আছে। কিন্তু কীভাবে করা হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‌প্রকৃত মূল্যস্ফীতি দুই বছর ধরে ২০ শতাংশ। মূল্য স্তর অনেক ওপরে উঠে যাওয়ায় মানুষ তার আয় দিয়ে ব্যয় সামাল দিতে পারছে না। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট নির্বাচনের ইশতেহারের সঙ্গে বিপরীতমুখী। ইশতেহারের দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলা হলেও বাজেটে তার প্রতিফলন নেই। আমরা আর কতকাল দুষ্টচক্রের মাথায় হাত বুলিয়ে সুবিধা দেব?’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন