আলোকপাত

রাতারাতি রিজার্ভ বাড়ানোর কোনো ম্যাজিক ফর্মুলা নেই

আবু আহমেদ

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ তলানিতে না গেলেও ওই দিকেই যাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে রিজার্ভ শুধু কমছেই। বর্তমানে যে জায়গায় স্থিতি আছে এতে বড়জোর আড়াই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আর অন্যান্য খাতের বৈদেশিক দেনা হিসাব করলে দেনা পরিশোধের ক্ষমতা আরো অনেক কম। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার জন্য অনেক তদবির করে চলেছে। তবে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দেবে, কারণ এ সংস্থা এখনো এই দেশকে একটা ভালো গ্রাহক মনে করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়লে এই সংস্থাও ঋণ দেবে না। আমাদের তদবির ও প্রতিশ্রুতির ধরন যা-ই হোক না কেন এখনো ভরসা আমাদের লোকদের কর্তৃক অর্জিত ও প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স। অন্য ভরসার জায়গা হলো আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি। সব ঋণদাতাই লক্ষ রাখে এই দুই ক্ষেত্রে কী হচ্ছে। তবে চলতি দেনা ও বাকি রাখা দেনা সাধ্যের বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশ কথিত দাতাদের ঋণ কীভাবে শোধ করে সেটি দেখার বিষয়। 

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রায় দেড় যুগ উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে পারফর্ম করার পর কেন হঠাৎ টানাপড়েনে পড়ল? আসলে বিষয়টি হঠাৎ ঘটেনি। বিষয়টি যে ঘটতে যাচ্ছে তা অনেক আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। এর মূল কারণ ছিল আমাদের বৈদেশিক ঋণ ও পুরনো বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে দেনা। আজ বাংলাদেশ তো আমদানির ক্ষেত্রে অনেক নিম্নমুখী অবস্থানে চলে এসেছে। আবারো কেন বৈদেশিক দেনার ক্ষেত্রে এত টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে গেল। উত্তর একটা, বৈদেশিক সূত্র থেকে নেয়া ঋণ। সেই ঋণের সুদ-আসল বৃদ্ধি পাচ্ছে, সামনে এই বোঝা আরো বাড়বে। তখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ দাতারাও ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে দূরে সরে যেতে পারে। আর আমরা আজ যেসব দেনা পরে দেব বলে বাকি রাখছি, তখন সেই দেনা দেয়ার জন্য আমাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে। আমরা কি আগামীকাল স্বর্ণখনি আবিষ্কার করব যে আজকের পাওনাগুলোকে কালকের জন্য রেখে দিচ্ছি! 

ঋণ কখনো বেশি করতে নেই। আর ঋণের দেনাও আগামীকালের জন্য রাখতে নেই। এই নীতি গ্রহণ না করলে পরে সম্পদ বেঁচে ঋণ শোধ করতে হয়। ঋণগ্রস্ত দেশকে কেউ ঋণ দেয় না। বিদেশীরা তখন ঋণ দিতে আগ্রহী হবে না, তবে সম্পদ ক্রয়ে আগ্রহী হবে। সেজন্য বলা হয়, কাপড় অনুযায়ী কোট সেলাই করুন। না হলে বিপদে পড়বেন। বাংলাদেশ দেনা দিতে না পারলে দুটি বিষয় ঘটতে পারে। কঠিন শর্তে এক ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তখন অবস্থা এমনই হবে যে ছোট কাপড়টা দিয়ে একদিক ঢাকতে গেলে অন্যদিক উলঙ্গ হয়ে পড়বে। এমন দেশের উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে অনেক আছে। যারা অতিব্যয় করতে গিয়ে অতিঋণ করেছে, পরে বিপদে পড়েছে। 

দেশীয় ঋণ না হয় মুদ্রা ছাপিয়ে পরিশোধ করা যাবে কিন্তু বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে তো সেটা করা যাবে না। যারা ঋণ দিয়েছে এবং যারা আমাদের কাছে সামগ্রী ও সেবা বিক্রি করবে তারা অর্থ চাইবে ডলারে। সেই ডলার আমাদের অর্জন করতে হবে। অর্জনের উৎস হলো তিনটি—রফতানি আয়, রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও নতুন ঋণ। বর্তমান অবস্থায় বৈদেশিক বিনিয়োগ খুব বেশি আশা করা যায় না। নতুন ঋণ পেতেও কষ্ট হবে। আর রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও সেটার ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও অনেকটা ধীর। সুদের হার বাড়ছে। আমাদের টাকা মূল্য হারাচ্ছে। অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় আছে। বিনিয়োগ-ভোগ কমে যাচ্ছে। এসব আলামত অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু নয়। 

আইএমএফ বলছে, বেশি ট্যাক্স কালেকশন করো। বিনিয়োগ-ভোগ কমে গেলে কীভাবে বেশি ট্যাক্স আহরণ হবে সেটা বুঝে আসে না। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টানাপড়েন পড়ল কেন? শুধুই কি বৈদেশিক দেনার বৃদ্ধির কারণে? বিষয়টা এমনও নয়। বাংলাদেশ থেকে বিরাট অংকের অর্থ পাচার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যে অর্থনীতিগুলো অর্থ পাচারের শিকার হয়েছে তারা দরিদ্রই রয়ে গেছে। অর্থ পাচারকারীদের মধ্যে রয়েছে ঋণখেলাপি ও যারা পদকে ব্যবহার করে দুর্নীতি করেছে। আর কিছু বড় ব্যবসায়ী। পৃথিবীতে আয় সরানোর বাধা বলতে এমন কিছু নেই। অর্থ হাতে আসলেই হলো, অর্থকে সর্বত্র স্থানান্তর করা যাবে। 

আইএমএফ প্রথমে বলেছিল তোমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপর থাকতে হবে। আমরা তখনো বলেছিলাম ওই সব আইএমএফের কেতাবি কথা। কোনো জাদুমন্ত্র দিয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ বাড়ানো যায় না। ট্যাক্স কালেকশন বাড়ানো যেতে পারে জনগণকে মেরে-পিটে। কিন্তু ফরেন এক্সচেঞ্জ বাড়ানোর কোনো সহজ ফর্মুলা নেই। হ্যাঁ, বাড়তে  পারে আমরা যদি আমদানি আরো কমিয়ে দিই। তাহলে আমাদের অর্থনীতিও আরো নিচের দিকে চলে যাবে। পুরো অর্থনীতিতেই দারিদ্র্যের ছায়া নেমে আসবে। আইএমএফের সঙ্গে এক ক্ষেত্রে আমার ভাবনার মিল আছে, সেটা হলো ছোট বাজেট প্রণয়ন। ঋণ করে বড় বাজেট প্রণয়নে কোনো কৃতিত্ব নেই। আজকে বাজেটের খাতগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে পুরনো ঋণের সুদ প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। 

ছোট সরকার, ছোট বাজেট আদর্শ হতে পারত। কিন্তু কে শুনে কার কথা? ঋণ করে ঘি খাওয়ার অভ্যাস পেয়ে বসলে ওই অভ্যাস ত্যাগ করা সত্যি কঠিন। আমাদের সরকারের আকার অনেক বড়। বড় আকারের সরকার অদক্ষ হয়। অনেক লোককে আমরা শুধু শুধু বেতন-ভাতা দিচ্ছি। ‍বড় এবং অদক্ষ সরকার একটা অর্থনীতিকে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। ওই ধরনের অর্থনীতিতে দুর্নীতি বাড়ে এবং জনগণের ট্যাক্সের অর্থে কিছু লোকই শুধু উপকৃত হয়। 

আজকে পদকে ব্যবহার করে সম্পদ আহরণে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। রুচির দুর্ভিক্ষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। জানি না এই সমাজ, এই অর্থনীতিতে আদৌ আলো দেখতে পাব কিনা। যে সমাজে ক্ষমতা ও পদ হয়ে পড়ে সম্পদ আহরণের বড় হাতিয়ার, সেই সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠী শুধু দরিদ্রই থাকে। সেই অর্থনীতিতে যত আয়ই প্রবাহিত হোক না কেন, ওইসব আয় এদের হাতে বন্দি হবে এবং এদের হাত দিয়ে সেই আয় বাইরে চলে যাবে। এসব অর্থনীতিতে ডলার সংকট চলছে এবং চলবে। বাংলাদেশ ভালো করে ভেবে দেখুক, ওই দিকে দ্রুত এগোচ্ছে কিনা। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের উন্নতির ভাবনাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আমরা শুধু দরিদ্রই থেকে যাব। মধ্যম আয়ের ও উন্নত দেশের আশা দুরাশাই থেকে যাবে। 

আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন