সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানবসৃষ্ট ও পরিকল্পিত: বাপা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

সুন্দরবনে বারবার অগ্নিকান্ডের ঘটনা মানবসৃষ্ট ও পরিকল্পিত বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মো. নূর আলম শেখ। তিনি বলেন, বারবার সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের ফলে সামগ্রিক ভাবে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অগ্নিকান্ডের এ ঘটনায় বনবিভাগ কোনো ভাবেই দায় এড়াতে পারে না।

বুধবার ( ২২ মে)  ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। ‘বারংবার আগুন সন্ত্রাসের কবলে সুন্দরবন: কারণ ও প্রতিকার’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা।

নূর আলম শেখ বলেন, সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি অঞ্চলে চোরা শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। গণমাধ্যমে এসেছে গত ২৪ বছরে সুন্দরবনে ২৫ থেকে ২৬ বার আগুন লেগেছে। সরকারি হিসেবে প্রায় শতাধিক একর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। মুনাফা লোভী মাছ ব্যবসায়ী ও অসৎ বনকর্মকর্তাদের যোগসাজশে বার বার সুন্দরবনে আগুন লাগানো হচ্ছে। এর দায়ভার বনবিভাগকেই নিতে হবে।

তিনি বলেন, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, পরিবেশকর্মী, সংবাদকর্মী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা, সুন্দরবনে অপরিকল্পিত খাল খনন এবং অতীতে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার কারণেই সুন্দরবনের আমুরবুনিয়া এলাকায় চার বছর পরে আবারো অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হলো।

নীতিনির্ধারকদের কাছে সুন্দরবন আজও গুরুত্বহীন দাবি করে নূর আলম শেখ বলেন, একজন বনজীবীর কাছে সুন্দরবনের আর্থিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। সুন্দরবন সংলগ্ন প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ বনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবন গুরুত্বপূর্ণ বস্তুতান্ত্রিক সেবা প্রদান করে। গবেষণায় সুন্দরবনের ২৪টি প্রতিবেশসেবার কথা উঠে এসেছে। প্রতি হেক্টর সুন্দরবনের প্রতিবেশসেবার আর্থিকমূল্য ৪৫৬ থেকে ১ হাজার ১৯২ মার্কিন ডলার। এ হিসেবে বছরে আমাদের সুন্দরবন ২৭ কোটি থেকে ৭১ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ প্রতিবেশসেবা প্রদান করে চলেছে।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বা বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন আজ ধ্বংসের মুখে। বার বার বনে আগুন লাগছে। এর থেকে সুন্দরবনকে ঠিক রাখতে আমাদের সঠিক কারণ নির্ধারণ করতে হবে। সুন্দরবন দুষ্টের সহজ গমন হলেও গবেষকদের জন্য দুর্গম। এ জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে একত্রে সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, সুন্দরবনের এসব ঘটনাকে প্রাকৃতিক কারণ বলে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় মোয়ালদেরকেও অভিযুক্ত করা হয়। তাদের পক্ষে এসব আগুন লাগানো সম্ভব নয়। বস্তুত মুনাফালোভীরাই পরিকল্পনা করে আগুন লাগিয়েছে।

সুন্দরবনের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল লোকদেরকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক কাদের।

নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, নির্দিষ্ট জায়গায় মার্চ-এপ্রিল মাসেই বারবার আগুন লাগছে। এ সময়ে প্রয়োজনে সেখানে সকল ধরনের যাতায়াত বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের বনাঞ্চল রক্ষার জন্য সকল শ্রেণির মানুষকে নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করা দরকার। 

সুন্দরবনে অগ্নিকান্ড বন্ধে নীতিনির্ধারকদের গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ১৫টি সুপারিশ করেছে বাপা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাপার জাতীয় কমিটির সদস্য ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী সুপারিশগুলো উত্থাপন করেন। 

ড. চৌধুরী বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ও অগ্নিকাণ্ড বন্ধে বনবিভাগ, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী, নৌ-পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, সংবাদকর্মী, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। বিগত দিনে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় ওয়াচটাওয়ার নির্মাণ করতে হবে। বনের মধ্যে অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে হবে। ড্রোন ক্যামেরা, সিসি ক্যামেরাসহ সুন্দরবন রক্ষায় বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।’

বাপার সহসভাপতি মহিদুল হক খানের সভাপতিত্বে ও বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের, বাপার যুগ্ম সম্পাদক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, বাপার কোষাধ্যক্ষ জাকির হোসেন প্রমুখ।

গত ৪ মে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের চিলা এলাকায় আগুন লেগে ৭ দশমিক ৯ একর বনভূমি পুড়ে যায়। দীর্ঘ ৪৭ ঘণ্টার চেষ্টায় ৬ মে ওই আগুন শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন