বাংলাদেশের রফতানি আয়ের মূল উৎস তৈরি পোশাক খাত। বর্তমানে তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান থেকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দাবি, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্ববাজারে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি দেশের মোট পণ্য রফতানিতে তৈরি পোশাকের অংশ গত অর্থবছরে বেড়ে ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২৩ অর্থবছরে এ খাতে জিডিপির অবদান ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেকটা শূন্য থেকেই। পদ্ধতিগত পশ্চাৎপদতায় উৎপাদনশীলতা ছিল কম। রফতানি পণ্য বলতে প্রধানত কৃষিপণ্যকেই বোঝানো হতো। শিল্প খাতেরও বিকাশ হচ্ছিল ধীরগতিতে। সত্তর দশকের শেষভাগের সে স্থবিরতাকে কাটিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের পদযাত্রার সূচনা। এ পণ্যের কাঁচামাল জোগানে শুরুতে পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতা থাকলেও পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্রশিল্প।
১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। ওভেন পণ্য নিয়ে প্রথম সে রফতানি চালানের গন্তব্য ছিল ফ্রান্স। ১০ হাজার পিস শার্টের ওই চালানের মোট মূল্য ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার ফ্রাঁ। লেনদেন হয়েছিল জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ছিল হল্যান্ডার ফ্রান্স।
দেশে এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে সরকার ক্রলিং পেগ পদ্ধতি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এ বিষয়ে আপনার কোনো প্রত্যাশা বা অভিমত রয়েছে কি?
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে ক্রলিং পেগ নিয়ে দিকনির্দেশনা আরো পরিষ্কারভাবে আসা উচিত। আমরা এখনো এ বিষয়টা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা করতে পারছি না। তাই এ বিষয়টা নিয়ে আরেকটু পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়ার দরকার আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটা দিকনির্দেশনা থাকলে সেই অনুযায়ী ব্যবসাটাকে গোছানো যায়।
রফতানি খাতে নগদ সহায়তা হ্রাসের ঘোষণা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
বলা হচ্ছে সামনে যে গ্র্যাজুয়েশন হবে এটার পর সব ইনসেনটিভ উঠিয়ে দেয়া হবে। ইনসেনটিভ উঠিয়ে দিলে আমাদের টেক্সটাইল ও আরএমজি খাত নিশ্চিতভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই এটা কীভাবে কমপেনসেট করবে সে বিষয়টি দেখতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। প্রধান যে তিনটি অপ্রচলিত বাজারে রফতানিকারকরা ভালো করছে, অর্থাৎ জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় রফতানির ক্ষেত্রে নতুন বাজারের রফতানি প্রণোদনা হ্রাস করা হয়েছিল। এ-সংক্রান্ত সর্বশেষ সার্কুলারে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমার উল্লেখ ছিল। এরপর কী হবে সে বিষয়টি আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত পরিষ্কার না। এ প্রেক্ষাপটে আমরা যদি ধরে নিই যে একটা পর্যায়ে ইনসেনটিভ সরিয়েই দেয়া হবে, সেক্ষেত্রে উৎসে কর একটু কমিয়ে তার সঙ্গে আরো কীভাবে ইনসেনটিভ দেয়া যায়—এ বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। আবার টেক্সটাইলের ক্ষেত্রে স্পেয়ার পার্টসের ওপরে এখন যে ট্যাক্সেশন আছে ওগুলো সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এখন নবায়নযোগ্য সৌরশক্তির ওপর অনেকেই ফোকাস করছে। আমরা তো নবায়নযোগ্য জ্বালানি বলতে সৌরশক্তিকেই বুঝি আপাতত। তাই এ জায়গাগুলোয় কাজ করতে হলে এগুলোর ওপর ট্যাক্সেশনগুলোকে ওয়েভ করে দেয়া উচিত। এক্সপোর্ট, নন-এক্সপোর্ট দুই ক্ষেত্রেই এটা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এটা হলো আরএমজির ক্ষেত্রে। আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। এ পর্যায়ে দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত যাতে রফতানিকারকরা অন্তত নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিতে পারে। একটা ইনসেনটিভ উঠে যাওয়া কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি। বিশেষ করে নতুন ম্যানমেইড ফাইবার এবং আমাদের যে মৌলিক পণ্যগুলো আছে এগুলোর বাইরে সিনথেটিক পণ্যের ওপরে আরো বেশি ইনসেনটিভ দিয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। যাতে রফতানিতে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে তো ওই ডাবল স্টেজ ট্রান্সফরমেশনটা দরকার এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য। সেক্ষেত্রে ডাবল স্টেজ ট্রান্সফরমেশন কী, সেটি বোঝার সুবিধার্থে একটা নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। এখন তো আমরা দেশের বাইরে থেকে কাঁচামাল এনে পণ্য বানিয়ে পণ্য রফতানি করি। ডাবল স্টেজ যদি হয় সেক্ষেত্রে তো হলো সবই আমাদের নিজস্ব সক্ষমতায় বানাতে হবে। অর্থাৎ কটন আনতে হবে, কটন থেকে ফাইবারে রূপান্তর করতে হবে, তারপর ফাইবার থেকে ইয়ার্ন, ইয়ার্ন থেকে ফ্যাব্রিক, ফ্যাব্রিক থেকে গার্মেন্টস। এ যে ট্রান্সফরমেশনটা, এটার জন্য একটা তো পলিসি ইনসেনটিভাইস করা উচিত। ইনসেনটিভের কাঠামোতে হয়তো নয়, কারণ ইনসেনটিভ তো আর দিতে পারবে না। তাই এটার জন্য একটা একটি পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দরকার। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে এটিই আমার মতামত।
আবাসন খাতেও আপনাদের ব্যবসা রয়েছে। এ খাত নিয়ে বাজেট ঘোষণায় প্রত্যাশা কী?
রিয়েল এস্টেটের বাজার এখন মন্থর। তার ওপর রিয়েল এস্টেটের ক্ষেত্রে বাজেটে হাউজিংয়ের সরকারি রেজিস্ট্রেশন খরচটা একটু বেশি। রেজিস্ট্রেশন খরচ বর্তমানে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ হয়ে গেছে। তাই রেজিস্ট্রেশন খরচটা যদি কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে ভলিউমে ট্যাক্সেশন করত। অর্থাৎ বেশি মানুষ জমি কিনত এবং কিনে রেজিস্ট্রি করত। তাহলে কোয়ান্টিটি দিয়ে রেভিনিউ কালেক্ট করা সম্ভব হতো। আমার মনে হয়, রেজিস্ট্রেশন খরচটা অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় করা উচিত এখন। এতে আরো মানুষ জমির ব্যাপারে উৎসাহিত হবে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রে রেজিস্ট্রেশন খরচ ৭ থেকে ৮ শতাংশ। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়ও ৭ থেকে ৮ শতাংশ যেখানে আমাদের ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। তাই হেভি ট্যাক্সেশন না করে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করলে সরকারের কোষাগারে আরো বেশি কালেকশন আসবে। এছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগকে ত্বরান্বিত করা গেলেও কালো টাকা অর্থনীতিতে অর্থ প্রবাহ বাড়বে, হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে না গিয়ে।
বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী স্থানীয় শিল্পের কী অবস্থা?
লোকাল ইন্ডাস্ট্রির একটা বিশাল প্রবলেম হলো এখন এলসি খোলা। যারা ডমিস্টিক্যালি মার্কেটে ব্যবসা করবে তাদের জন্য এটা খুবই কঠিন যেমন গার্মেন্টসের ক্ষেত্রে আমার সমস্যা নেই, গার্মেন্টসে আমার ডলার বাইরে থেকে আসে। আমার আবার এলসিও খুলতে হয় পরপর। আমার পেমেন্ট কিন্তু ডলার থেকে ডলার হয়ে যায়। তাই রফতানিমুখী শিল্পে এ সমস্যা নেই। কিন্তু আমার যে দেশীয় বাজারমুখী শিল্প, সেই শিল্পের জন্য যদি আমি এলসি খুলি, আমার তো বেচাকেনা হয় টাকায়। আপনি আমার কাছ থেকে ১০০ টাকায় কিনে ১০০ টাকাই দেন কিন্তু এ টাইলস বানাতে আমার যে ৭০ টাকা খরচ লাগে, সেটা তো আমার ডলারে পেমেন্ট করতে হয়। যে কারণে ব্যাংকে এলসি দিতে চায় না। অন্তত ডমেস্টিক মার্কেটকে সুরক্ষিত রাখতে একটা রিজার্ভ দরকার। কারণ ডমেস্টিক ইন্ডাস্ট্রি জিডিপিতে বড় অবদান রাখে। শুধু সিরামিক নয়, সামগ্রিকভাবে স্থানীয় বাজারনির্ভর শিল্প জিডিপিতে অনেক বড় অবদান রাখে। এ ডমেস্টিক মার্কেটে যারা বাইরে থেকে পণ্য এনে দেশে বেচে, তাদের জন্য এলসি খোলাটা কিন্তু এখনো খুবই কষ্টসাধ্য। বড় গ্রুপগুোর জন্য প্রেফারেন্স থাকে কিন্তু ছোট ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা বেশ কঠিন। ওরা এলসি খুলতে পারে না। পুরো টাকা ক্যাশ দিয়ে এলসি খোলে। মনে করেন, আমি ১০০ টাকার কাঁচামাল আনব, এটার জন্য ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ ব্যাংককে মার্জিন দিতে হবে, এরপর এলসি খুলি। এর সুবিধাটা কী? পণ্য বিক্রি করে বাকি টাকাটা দেই। এখন আপনি যদি ৭০ টাকা প্রথম দিনেই দিয়ে দেন তাহলে তো পণ্য বিক্রি করতে করতে আপনি ফকির হয়ে যাবেন! এখন তো ফুল মার্জিনে এলসি খুলতে হয়। এ কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসায় সংগ্রাম করছে।
অনেক ব্যাংকে আবার মার্জিনও অনেক বেশি। ১২ থেকে ১৩ শতাংশ মার্জিনে তারা এলসি খোলে। ট্যাক্সেশনের ক্ষেত্রে টাইলসকে এখনো বাংলাদেশে বিলাস পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিলাসপণ্যের ওপর আবার সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি আছে ১৫ শতাংশ। কিন্তু টাইলস এখন আর বিলাসদ্রব্য বা লাক্সারি পণ্য না। এরই মধ্যে এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে বাংলাদেশে। তারপরও এখনো ২০ শতাংশ ইমপোর্ট হয় শুধু ট্যাক্সেশনের কাঠামোর কারণে।
শিরিষ কাগজে আপনারা বিনিয়োগ করেছেন। এ খাতের পরিস্থিতি কী?
শিরিষ কাগজের ক্ষেত্রে বললে বর্তমানে এটা শতভাগ আমদানিনির্ভর। এটা আটকানোর জন্য কোনো ট্যাক্সেশন নেই। আন্ডার ইনভয়েস করে মানুষ এটা নিয়ে আসে। ১০ ডলারের পণ্য আড়াই ডলারে দেখিয়ে নিয়ে আসে। এটার ওপরে কোনো মিনিমাম ভ্যালু দাঁড়ায় না। এটাকে আড়াই ডলারে যে ডিক্লেয়ার দিয়ে আনে চাইলেই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এর ভ্যালু বাড়াতে পারে। কিন্তু তা না করায় লোকাল ইন্ডাস্ট্রি সংগ্রাম করছে। কর্মসংস্থান কমছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে না। ৫০০-৭০০ মিলিয়ন ডলার বছরে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে হুন্ডি অবস্থায়। মিনিমাম ভ্যালু আড়াই ডলার হওয়ায় সরকার ট্যাক্স পাচ্ছে না।
হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কিছু বলেন।
হোটেলের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতো মূল্য সংযোজন কর যদি কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে বেচাকেনা আরো বেশি হবে। অন্যান্য দেশে হোটেলে ৫-৬ শতাংশ ভ্যাট হয়। আমাদের দেশে মনে হয় সেটা ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। হসপিটালিটি খাতে এটা অনেক বড় একটা সমস্যা। কারণ সেল যত বাড়বে কালেকশন তত হবে। ভলিউমটা ম্যাটার করে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম