বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রেহমান সোবহান

প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশী বিনিয়োগ পাকিস্তানের চেয়ে কম

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে গতকাল বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে গড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশী বিনিয়োগ পাকিস্তানের চেয়ে কম আসছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ‘‌আইনকে পাশ কাটিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করার প্রবণতার ফলে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে বলে কেউ বিশ্বাস করছে না। তাই এখানে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে না।’ গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, ‘‌দেশের নীতি ও পলিসিগত ব্যর্থতার কারণে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ ব্যবস্থা ঠিক করে দেয় কার ঋণ পুনঃতফসিল হবে, আর কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আবার ঋণখেলাপিরা নির্বাচনের আগে ৫-১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে নির্বাচন করার সক্ষমতা অর্জন করছে। প্রতি নির্বাচনের আগে এমন নাটক করা হচ্ছে। ফলে নির্বাচিত হয়ে বাকি চার বছর তার আর ঋণ পরিশোধ করার দরকার হয় না। সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের আত্মীয়স্বজনরা সব কাজ পেয়ে যায়। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে উচ্চ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিষ্পাপ শিশুর মতো। ফলে দেশে কোনো নিয়ম আছে বলে কেউ বিশ্বাস করে না।’ আর বছর বছর ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় বলে খেলাপির সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ।

এর আগে ‘‌ইজ দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল?’ বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বইটির লেখক সেলিম রায়হান বলেন, ‘‌বইটিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেশে আসলে বিস্ময়কর কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং মানসম্মত প্রাতিষ্ঠানিকরণ ছাড়াই এক ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। পোশাক খাতের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি এসেছে। তবে পরবর্তী ধাপে এ ধরনের প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ব্যতীত দ্বিতীয় ধাপের প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব না। কারণ এখানে শিল্প ব্যবস্থাপনায় শুধু পোশাক খাতই লাভবান হয়েছে। নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে। রাজস্ব ও বাজেট বাস্তবায়ন কমেছে। দুর্নীতির স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে। আর এসব দূরীকরণে শক্তিশালী সংস্কারবিরোধী শক্তি গড়ে উঠেছে। যার পরিবর্তনে শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।’

বইটির আরেক লেখক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘‌একদিকে ব্যাংক ভালো ব্যবসা করছে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতে আবার ঋণখেলাপি বাড়ছে। এটাই একটি স্ববিরোধী অবস্থান তৈরি করছে, যাকে আমরা প্যারাডক্স বলছি। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি বেসরকারি ব্যাংকে এসে পড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে স্বায়ত্তশাসন দিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’ ব্যাংক মার্জারের মাধ্যমে আমানতকারীর নিরাপত্তা বাড়লেও এটা ব্যাংক খাতের সমস্যাকে দীর্ঘায়িত করবে বলে মনে করেন তিনি।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ বলেন, ‘‌এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসন পেলেও সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না আমার। কারণ এখানে নেতিবাচক শক্তি বেশি শক্তিশালী। তাই নীতির বাস্তবায়নই বড় সমস্যা। অসৎ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ও আমলার একটি চক্র গড়ে উঠেছে এখানে। আবার সরকারে শক্তি এখানে কোন শ্রেণীর জন্য ব্যবহার হচ্ছে এবং কোন শ্রেণীর জন্য ব্যবহার হচ্ছে না—সেটাও বড় প্রশ্ন। ভূ-রাজনীতিও একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। বাইরের শক্তি সরকারকে উৎসাহিত করছে। রাশিয়া, চীন, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ মেগা প্রকল্পের জন্য টাকা দিচ্ছে। যদিও পশ্চিমারা বেশি সায় দিচ্ছে না। তাই এখানে প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা পর্যালোচনা করা হলেও কীভাবে এটার পরিবর্তন হবে তা এখনই বলা যাবে না।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বলেন, ‘‌শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা পাওয়ার কারণে দেশের পোশাক খাত সফলতা পেয়েছে। কিন্তু রক্ষণশীল শুল্ক কাঠামোর কারণে অন্য প্রায় ৫০০ পণ্যের রফতানি বাড়ছে না। পোশাক খাত এ সুবিধা পেয়েছে নব্বইয়ের দশকে। এখন যৌক্তিক শুল্ককাঠামো ঠিক না করলে রফতানি পরিস্থিতির চিত্র বদলাবে না।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘‌আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করা কঠিন। এটাকে সতর্কতার সঙ্গে দেখা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বায়ত্তশাসন পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না, কারণ সাবেক আমলা দিয়ে সেখানকার বোর্ড পরিচালিত হয়। আর সরকারের রেগুলেটরি বডিগুলোয় সরকারের প্রতি জবাবদিহিতা করা ছাড়াও পারফরম্যান্স অডিট করা উচিত। আমরা কয়েক বছর পরপর শিল্পনীতি আপডেট করব। যাতে এ নীতির আলোকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ পেতে পারে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন