একটি শিশু নানা রকম শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। তেমনই একটি জন্মগত ত্রুটি হলো ডাউন সিনড্রোম, যার জন্য শিশুর সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সঠিক পরিচর্যা, চিকিৎসা ও উপযুক্ত পরিবেশে বড় করতে পারলে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।
ডাউন সিনড্রোম
মানুষের দেহ অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকে ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোমের ভেতরের ডিএনএ অণুকে বলা হয় বংশগতির ধারক ও বাহক। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত হয় ডিএনএ দ্বারা। ডিএনএ বা ক্রোমোজোমে কোনো অসামঞ্জস্য দেখা দিলে একটি শিশু বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। একে জন্মগত ত্রুটি বা জিনগত ত্রুটি বলে। ডাউন সিনড্রোম শিশু সে রকম একটি জিনগত ত্রুটিযুক্ত শিশু, যার শরীরের ২১তম ক্রোমোজোমটির সঙ্গে অতিরিক্ত আর একটি ক্রোমোজোম থাকে।
কারণ
মানুষের দেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। ডাউন সিনড্রোম হলে একটি বাড়তি ক্রোমোজোম ২১তম ক্রোমোজোম জোড়ের জায়গায় চলে আসে। তখন ২১তম ক্রোমোজোমের স্থানে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২টির জায়গায় ৩টি হয়ে যায়। একে ‘ট্রাইসমি ২১’ বলে। প্রায় ৯৫ শতাংশ ডাউন সিনড্রোম এ কারণে হয়। এছাড়া—
শরীরের কিছু কোষে অতিরিক্ত দু-তিনটি করে ২১তম ক্রোমোজোম থাকলে ডাউন সিনড্রোম হয়। একে মোজাইক ডাউন সিনড্রোম বলে।
২১তম ক্রোমোজোমের অতিরিক্ত ক্রোমোজোমটি অন্য কোনো ক্রোমোজোমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলে ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম হয়। একে ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিনড্রোম বলে।
৩৫ বছর বয়সের পর কোনো নারীর সন্তান হলে সেই শিশুর ডাউন সিনড্রোম হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
কোনো দম্পতির আগের সন্তানের ডাউন সিনড্রোম থাকলে পরের সন্তানেরও ডাউন সিনড্রোম হতে পারে।
শনাক্তকরণ
গর্ভাবস্থার ২৪ সপ্তাহের মধ্যে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, মায়ের রক্ত পরীক্ষা, ভ্রূণের কোষ পরীক্ষা—এসবের মাধ্যমে সহজেই জানা যায় গর্ভের শিশুটির ডাউন সিনড্রোম আছে কিনা।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কিছু বিশেষ শারীরিক ও স্নায়বিক লক্ষণ দেখা যায়। যেমন—
এই শিশুগুলো খুব নরম হয় এবং শরীরে ফোলা ভাব থাকে।
এরা দেরিতে হাঁটতে, বসতে ও কথা বলতে শেখে।
এদের বুদ্ধিমত্তা অনেক কম হয়।
হাঁটাচলা ও মাংসপেশির গঠন স্বাভাবিক হয় না।
এদের মুখমণ্ডল ও গলা ছোট হয়।
জিহ্বাটা একটু বের হয়ে থাকে।
উচ্চতা কম হয়।
হাত-পা ও আঙুল ছোট হয়।
অনেকেই কানে কম শোনে।
হাতের তালুতে একটিমাত্র রেখা থাকে।
নাক চ্যাপ্টা ও কান ছোট হয়।
চোখের কোনা ওপরের দিকে উঠে থাকে।
শিশুর শারীরিক জটিলতা
ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। বেশির ভাগ শিশুর—
জন্মগত হৃদরোগ থাকে
স্থূলতার সমস্যা থাকে
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক কম হয়
থাইরয়েডের সমস্যা থাকে
বয়স যত বাড়ে, স্মৃতিশক্তি তত কমতে থাকে
স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাতজনিত সমস্যা হয়
পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ হয়
হাড় ও দাঁতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে
ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব সমস্যাও বৃদ্ধি পায়।
চিকিৎসা ও করণীয়
ডাউন সিনড্রোম শিশু যেহেতু নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাই জন্মের পর থেকেই তাদের যথাযথ চিকিৎসা ও পরিচর্যা করা জরুরি। যেসব শিশুর হার্টের সমস্যা থাকে তাদের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা করাতে হবে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকার কারণে শিশুকে ফ্লু ভ্যাকসিন দিতে হবে। ডাউন সিনড্রোম শিশুর শরীরে থাইরয়েড হরমোনের অভাব হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুকে হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি দেয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময় পরপর চোখ ও কানের পরীক্ষা করাতে হবে। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো জরুরি। পাশাপাশি একজন স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট ও অকুপেশনাল থেরাপিস্টের অধীনে নিয়মিত থেরাপি দিতে হবে। এতে তাদের হাঁটাচলা, কথা বলা, ঠিকভাবে খাবার খাওয়া, পোশাক পরাসহ অন্যান্য আচার-আচরণে অগ্রগতি আসবে। শিশুকে বিভিন্ন সামাজিক ও বিনোদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করাতে হবে, যাতে তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আসে। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর প্রতি মা-বাবাসহ পরিবার তথা সমাজের অধিক যত্নবান ও সহনশীল হওয়া আবশ্যক।
লেখক: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
জুনিয়র কনসালট্যান্ট
ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকস অ্যান্ড নিওনেটোলজি, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল