অভিমত

আমাদের আবাসন পরিকল্পনায় কেন অনুপস্থিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী?

মাহফুজুল হক জগলুল

ছবি : বণিক বার্তা

একজন স্থপতি হিসেবে এ দেশের সামগ্রিক আবাসন ব্যবস্থার দিকে আমরা যদি নির্মোহভাবে তাকাই তখন লজ্জিতভাবে দেখতে পাই, কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছাড়া আমরা স্থপতিরা সামগ্রিকভাবে প্রধানত এ দেশের এলিট অধিপতি শ্রেণীর জন্যই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সারা জীবন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। বাস্তব চিত্র হচ্ছে, আমাদের শহুরে অধিপতি শ্রেণী এ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামীণ মানুষের আবাসন ব্যবস্থা ও এর স্থাপত্য নিয়ে এক সীমাহীন অবজ্ঞা ও অসচেতনতা নিজেদের মননে লালন ও চর্চা করে চলেছে, অথচ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান কাজই হওয়া উচিত ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবাসন উন্নয়নে নিরন্তর গবেষণা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের মূলধারাসহ আমাদের রাজনৈতিক ও আমলা নিয়ন্ত্রিত প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার মধ্যেও একই অবজ্ঞা ও অসচেতনতার উপস্থিতি সুস্পষ্ট। শহরের ১৫ শতাংশেরও কম জনসংখ্যার জন্য আছে রাজউক, সিডিএ, কেডিএ, সিটি করপোরেশন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, পিডব্লিউডি, ডিপার্টমেন্ট অব আর্কিটেকচার, হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনসহ অগণিত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও বিশেষায়িত গৃহ ঋণ বিতরণ প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে গ্রামীণ ৫ শতাংশ অবস্থাসম্পন্নদের বাদ দিয়ে দেশের বাকি ৮০ শতাংশ মানুষের আবাসনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বা নীতিমালাভিত্তিক তেমন কোনো বৃহদাকার জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। সরকারিভাবে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেখানে মানুষকে তাদের জন্ম জন্মান্তরের পিতৃপুরুষের ভিটা থেকে দূরে অচেনা-অজানা পরিবেশে গুচ্ছগ্রাম জাতীয় আবাসন প্রকল্পে স্থান দেয়া হয়। গ্রামীণ মানুষের মনস্তত্ত্বের নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় সেটা একটা অকার্যকর সমাধান। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামীণ মানুষ পলিথিনের বেড়া দিয়ে খুপড়ির মধ্যে থাকবে, কিন্তু পিতৃপুরুষের পরিচয় সংবলিত ভিটা ছেড়ে অন্যত্র যাবে না, এটাই তাদের মনস্তত্ত্ব। এছাড়া এভাবে মানুষকে তার মূল থেকে উচ্ছেদ করে অন্যত্র মাইগ্রেশনে বাধ্য করাও কোনো অর্থেই মানবিক নয়, তবে যারা নদীভাঙনে বা অন্য যেকোনো কারণে বাস্তুভিটা হারা হয়েছে শুধু তাদের ক্ষেত্রে গুচ্ছগ্রাম ধারণা কার্যকর হতে পারে। 

মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে একটি সাধারণ মানের গ্রামীণ ঘর বানানো সম্ভব, কিন্তু এ সামান্য আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় সর্বজনীন নীতিমালা নেই। নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে, স্থপতি হিসেবে আমরা আমাদের অনেক প্রজেক্টের একটি টয়লেটে যে টাকা খরচ করতে দেখি সে টাকায় অনায়াসে পাঁচটি গ্রামীণ ঘর নির্মাণ করে দেয়া যায়। বৈষম্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা স্থপতিরা কি এ অমানবিক সিস্টেমের দোসর হব, নাকি নিতান্ত দর্শক হব, না বিকল্প অন্য কোনো চিন্তাকে উসকে দিতে চেষ্টা করব, সেটা আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ সীমাহীন অমানবিক বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশের পেশাজীবী স্থপতিদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট’ সিদ্ধান্ত নেয় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আবাসন নিয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) একটি প্রকল্প গ্রহণ করবে, যা আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও নীতিনির্ধারকদের চিন্তাকে নাড়া দেবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থপতিরা তাদের নিজস্ব সংগ্রহকৃত তহবিল থেকে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক পর্যায়ে ১০০টি ঘর নির্মাণের সংকল্প করে, প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়, ‘১০০ বাড়ি প্রকল্প’। ১০০ হলো একটি প্রতীকী সংখ্যা, দিনশেষে এটা ১০০ হতে পারে, ২০০ হতে পারে, ১০০০ হতে পারে বা একে সাফল্যের সঙ্গে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিতে পারলে এটা অসংখ্যও হতে পারে। আমরা আশা করছি, প্রকল্পটি সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে গেলে এটি আমাদের জাতীয় আবাসনের চিন্তাচেতনায় একটি বিশাল পরিবর্তনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পারবে। 

প্রকল্পের আওতায় পূর্ব গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ে দেশকে পৃথক আটটি অঞ্চলে ভাগ করে ১০০টি ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাগেরহাট জেলার কচুয়া ও সুন্দরবন-সংলগ্ন দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ২০ জন স্থপতির একটি দল গত বছরের মে মাসে সরজমিনে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রায় ২৫টি ঘর থেকে সাতটি পরিবারের জন্য ঘর ডিজাইন ও নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। স্থপতিরা যে শুধু ঘর নির্মাণেরই ব্যবস্থা করছে তা নয়, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থপতিরা হাতে-কলমে গবেষণা করার সুযোগ পাচ্ছে; কীভাবে গ্রামীণ ঘরের ডিজাইন, কাঠামো ও নতুন নির্মাণসামগ্রী নির্বাচন ও ব্যবহারের মাধ্যমে গৃহগুলোকে আরো বেশি টেকসই ও বসবাস উপযোগী করা যায়। যেমন কীভাবে জোয়ারের পানি বা প্লাবনের বিরুদ্ধে দক্ষিণাচলের ঘরের প্লিন্থের শক্তি ও সহনশীলতা আরো বাড়ানো যায় বা সিআই শিটের পরিবর্তে অন্য কোনো লাগসই ও দীর্ঘস্থায়ী ম্যাটেরিয়াল লাগানো যায় কিনা এবং কীভাবে গৃহে ব্যবহৃত কাঠ আরো বেশি দীর্ঘস্থায়ী করা যায়, কীভাবে সিআই শিটের জন্য ঘরের ভেতরের উদ্ভূত তাপমাত্রা আরো কমানো যায়—১০০ সদস্যের নবীন ও অভিজ্ঞ স্থপতিদের নিয়ে গঠিত বাস্থইয়ের একটি বড় দল কাজ করে যাচ্ছে। এ দলে এমন অনেক স্থপতিও আছেন যাদের অনেকেই স্থাপত্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত। এ দলেরই সদস্য প্রখ্যাত প্রকৌশলী শামসুল আলম বিটু স্থানীয় মাটির সঙ্গে ৫ শতাংশ সিমেন্ট, খড় ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে জোয়ারের পানি সহনীয় মাটির প্লিন্থ বানানোর জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি এ দল করছে সেটা হচ্ছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উডটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলামের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামীণ স্থাপত্যের বিশিষ্ট গবেষক স্থপতি শিবু বসুর সরাসরি সহযোগিতায় স্থানীয় লাগসই প্রযুক্তি ও ট্রিটমেন্ট ট্যাংক নির্মাণ করে নিজ নিজ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও সম্প্রদায়কে নিয়ে কাঠকে সহজে ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা, যেন ব্যবহৃত কাঠের স্থায়িত্ব বাড়ানো যায়। 

এছাড়া ডিজাইনের ক্ষেত্রে ঘরের পার্শ্ববর্তী খাল, বিল, নদী, অন্যান্য জলাধার, গাছপালা, ঘরের ওরিয়েন্টেশন, এলাকার অতীত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস ও রেকর্ড, তাদের পারিবারিক ও আর্থিক বাস্তবতা ও আশপাশের কমিউনিটি ও তাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অবস্থান ও আন্তঃসম্পর্ককে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। 

কচুয়ার পর প্রায় ২৪ সদস্যের একটি দল ভোলা জেলার বিভিন্ন গ্রামে সরজমিনে জরিপ চালিয়ে ২১টি ঘর নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার কাজ বর্তমানে চলমান আছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দুই মাসের মধ্যেই এগুলোর কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। এছাড়া বাস্থই চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে সংযুক্ত করে উপকূলীয় জেলা মহেশখালীতে উপকূলীয় নানা বিশেষ বাস্তবতাকে নিরিখে নিয়ে লাগসই ডিজাইনের ঘর নির্মাণ প্রকল্প নিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে রংপুরের কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম অঞ্চলে পরবর্তী প্রকল্পগুলো গ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। 

পুরো কার্যক্রমেই কমিউনিটি পার্টিসিপেশনকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কাজটি এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। যেসব দুস্থ পরিবারকে ঘর দেয়া হয়েছে তাদের উঁচু ঘরের প্লিন্থের মাটি ভরাটেও স্থানীয় প্রতিবেশীরা অংশগ্রহণ করেছেন। ঘরের কাঠের জালির কারুকাজ, ঘরের প্লিন্থে লাল রঙের অক্সাইড ব্যবহার বা কাঠের ওপর নানা লোকজ কারুকাজ স্থানীয় কমিউনিটির সদস্যরা নিজেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছেন, বাস্থইয়ের ডিজাইন টিম এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। ঘরের কাজ শেষ হওয়ার পর তাদের রঙ ও ব্রাশ দেয়া হয়েছে, তখন মহা উৎসাহে গ্রামের মহিলারা মিলে তাদের স্বপ্নের ঘর রঙ করেছেন তাদের একান্ত নিজস্ব শিল্পবোধ অনুসারে। আধুনিক গ্রাফিক্সে শিক্ষিত আমাদের স্থপতিরা গ্রামীণ মহিলাদের সে ডিজাইনে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি, বরং তাদের কাছ থেকে এ দেশের জলমাটির নিজস্ব নকশা ও শিল্পবোধের পাঠ গ্রহণ করে নিজেদের সমৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন। দিনশেষে ঘরের যে ডিজাইনটি দাঁড়িয়েছে সেটা হচ্ছে বাস্থইয়ের ডিজাইন টিম ও স্থানীয় প্রজ্ঞা (vernacular wisdom) এবং কমিউনিটির সম্মিলিত চিন্তাভাবনা ও অংশগ্রহণের ফসল। স্থানীয় মাটি ও মানুষের শাশ্বত শিল্পবোধকে আমরা সম্মান দিতে চেয়েছি এবং একে নতুন চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছি। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু যে গ্রামীণ মানুষই উপকৃত হবে তা-ই নয়, বরং নগরের স্থপতিরাও ডিজাইনার হিসেবে অনেক কিছু হয়তো শিখতে পারবেন এবং এ দেশের মাটি, মানুষ, স্থানীয় সংস্কৃতি ও সর্বোপরি প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত করে নিজেদের মনন ও চেতনাকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারবেন। বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেখানে শহরের অধিপতি শ্রেণীর নান্দনিক বোধের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের নান্দনিক বোধের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পৃথিবীর অন্য কোনো সমাজে নান্দনিক বোধ ও সাংস্কৃতিক বোধের এমন বিস্তর ফারাক দেখা যায় না, এটা চরম অসুস্থ একটা বাস্তবতা। আশা করা যায় এ কার্যক্রম আরো এগিয়ে গেলে এ পার্থক্য অনেক কমবে এবং একটি সুস্থ সিন্থেসিস প্রক্রিয়া শুরু হবে। সাইফুল হক, জালাল আহমেদ, মেরিনা তাবাসসুম, খন্দকার হাসিবুল কবির, সুহেলি ফারজানা, রিজভি হাসান, খাজা ফাতমি, সাদ বেন মোস্তফাসহ আমাদের অনেক প্রতিভাবান স্থপতি অনেক আগে থেকেই গতানুগতিক নাগরিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে প্রান্তিক জনসাধারণের সঙ্গে মিলেমিশে স্থানীয় দেশজ উপকরণ ব্যবহার করে ভিন্নমাত্রার অনেক অসাধারণ কাজ করেছেন, যা সারা বিশ্বে সমাদৃত, প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হচ্ছে। এ প্রকল্পের পেছন থেকে এক দল আগ্রহী অ্যাকাডেমিশিয়ান ও গবেষক আমাদের এ কার্যক্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি স্থানীয় প্রকল্পের সঙ্গে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে। কচুয়া প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত আছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এর নেতৃত্বে আছেন স্থাপত্য বিভাগের প্রধান স্থপতি সেরাজুল হাকিম। অন্যদিকে ভোলা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে সাউথ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়। এর নেতৃত্বে আছেন বিভাগীয় প্রধান স্থপতি ড. মাসুদ রশিদ, যার পিএইচডি গবেষণার বিষয়ই ছিল দক্ষিণ বঙ্গের গ্রামীণ স্থাপত্য। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থপতি, প্রকৌশলী ও প্রান্তিক মানুষের যে অভিজ্ঞতা হবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা রেকর্ড করবেন, ডকুমেন্টেশন করবেন, তা নিয়ে গবেষণা করবেন এবং নানা উপায় উদ্ভাবনের জন্য সচেষ্ট থাকবেন। এ অভিজ্ঞতার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ স্থাপত্য ও জনমানুষের সঙ্গে স্থপতিদের যে সেতুবন্ধ তৈরি হবে তা আমাদের আগামীর সার্বিক স্থাপত্য চিন্তা ও দর্শনের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্চিন্তনের ক্ষেত্রে হয়তো নতুন কোনো সৃষ্টিশীল জানালা খুলে দেবে। হয়তো দেখা যাবে, দিনশেষে তাদের অনেক কিছু শেখাতে গিয়ে নগরের স্থপতিরা তাদের কাছ থেকে অনেক বেশি শিখে এসেছেন। আমরা আশা করছি, এ প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব ডিজাইন হবে ও সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন হবে, তা নিশ্চয়ই আমাদের ওপর ঐতিহাসিকভাবে আরোপিত ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস জোগাবে এবং আমাদের একান্ত নিজস্ব অঞ্চলের জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি ও জনমানুষের ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়ে অনেক বেশি সংগতিপূর্ণ, অনেক বেশি দুর্যোগ সহনীয়, অনেক বেশি আরামদায়ক ও অনেক বেশি প্রাণবন্ত একটি গ্রহণযোগ্য মডেল খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। তবে এটা একদিনের কাজ নয়, এটা আমাদের স্থপতিদের চিন্তাচেতনা ও আমাদের শিক্ষা কারিকুলামের একটি চলমান প্রক্রিয়া হতে হবে। অন্য একটি আশার দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবেও প্রকল্পটি বহু দেশের ও প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত বছর শতাধিক দেশ নিয়ে গঠিত International Union of Architects (UIA)-এর কোপেনহেগেন কংগ্রেসের Community Architecture & Human Rights সম্মেলনে এবং ২৩টি দেশ নিয়ে গঠিত ARCASIA-এর ফিলিপাইন সম্মেলনে প্রকল্পটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয় এবং লেবানন, মিসর ও নেপাল প্রকল্পটি তাদের দেশে শুরুর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে।

মনে রাখতে হবে, আমাদের বর্তমান জাতীয় আবাসন নীতিমালা বা সার্বিক ব্যবস্থা ও আমাদের স্থাপত্য মোটামুটি এ ৮০ শতাংশ মানুষকে বাইরে রেখে চলমান আছে। এ পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ অবস্থাকে নির্দেশ করে না। আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল চেতনা; সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না, যদি দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের আবাসন নিয়ে আমরা কার্যকর চিন্তাভাবনা না করি।

মাহফুজুল হক জগলুল: স্থপতি, সহসভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন