অভিমত

শুধু আইন দিয়ে এআইয়ের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে!

হানযালা হান

ছবি : বণিক বার্তা

৬ আগস্ট, ১৯৪৫। লোয়ার সারানাক লেক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। ছুটি কাটাতে নৌবিহারে এসেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। রেডিওতে বেজে ওঠা একটি খবর তার কানে এল। মুহূর্তে মনটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন আইনস্টাইন। খবরটা ছিল, জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

আইনস্টাইন চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র যেন পারমাণবিক বোমা বানায়। কিন্তু কারো ওপর সেটা মারার দরকার নেই। কেবল নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই লক্ষ্য। কারণ হিটলারের জার্মানি এ বোমা বানাতে পারে। এজন্য তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটি চিঠিও লিখলেন। মূলত এ চিঠি যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। 

১৯৭০ সালে ১৯০টি দেশ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর সেই আইন যথেষ্ট কিনা তা যাচাইও করা হয়।

এসব কথা বলার কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। যাকে সোজা বাংলায় বলা যায় বুদ্ধিমান যন্ত্র। এই এআইকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এআইয়ের ঝুঁকি ও সুবিধা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা প্রণয়নের জন্য কাজ করছে। সর্বশেষ ২১ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে এআই-সম্পর্কিত প্রথম বৈশ্বিক প্রস্তাব পাস হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। সহপ্রস্তাবক ছিল আরো ১২৩টি দেশ। ১৯৩টি দেশ এআই নিয়ে প্রস্তাবটির পক্ষে হ্যাঁ ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রস্তাবটি এআইয়ের এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করবে। এখানে প্রতিটি দেশ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ও ঝুঁকি মোকাবেলায় এক হয়ে কাজ করবে। প্রস্তাবটিকে এআই বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধারাবাহিক উদ্যোগের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এর আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ এআই নিয়ন্ত্রণে প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এআই আইন তৈরির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ইউরোপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনপ্রণেতারা চলতি মাসে এআই নিয়ন্ত্রণে একটি অস্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।

বাংলাদেশেও এআই নিয়ন্ত্রণের ঢেউ এসে লেগেছে। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে এআই আইনের খসড়া তৈরি করা হবে। ২২ মার্চ বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, এআই যেভাবে পৃথিবী বদলে দিচ্ছে, সেটার ব্যাপারে একটি আইন সারা পৃথিবীতে চিন্তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও একই রকম চিন্তা করছে। সেই চিন্তা থেকেই আইনের একটি মৌলিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আমরা আইনমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। আমরাও অনুভব করি, এআইকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমরা এআই নিয়ে আমাদের উদ্বেগ এবং প্রশ্নগুলো উত্থাপন করতে চাই।

আমরা এ কারণে উদ্বিগ্ন যে, পৃথিবীতে বহু রকমের মারণাস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা দেশে নানা নামে আইনও রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন বহু মানুষ এসব অস্ত্রের আঘাতে মারা যাচ্ছে। শুধু আইন দিয়ে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। এ কারণে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, শুধু আইন দিয়ে কি এআইয়ের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?

কিছু কিছু অঞ্চলে আত্মরক্ষার্থে অস্ত্রের ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখি এসব অস্ত্রের কারণে বহু মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্র হামলাগুলো আমাদের হতবাক করে দেয়। আত্মরক্ষার্থে অস্ত্রের ব্যবহারের অনুমতির সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন জড়িত। তা হচ্ছে, কোনো দেশ কি আত্মরক্ষার্থে অন্য দেশের ওপর হামলা চালাতে পারে? বিশেষ করে নতুন করে যুদ্ধ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়া আজকের এ পৃথিবীতে প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ একদিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাচ্ছে রাশিয়া। অন্যদিকে ইসরায়েল একই যুক্তিতে গাজায় আগ্রাসন চালাচ্ছে। আমরা জানি, পৃথিবীর বহু দেশের সরকার উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিরোধী মতকে দমন করছে।

এটা ঠিক, আরব বসন্ত সৃষ্টির পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু সেই যুগ আর নেই। সোশ্যাল মিডিয়া তথা অনলাইন নিয়ন্ত্রণে উন্নত প্রযুক্তি ও আইন তৈরি হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তির সুফল যতটা না পাচ্ছে জনগণ তথা সাধারণ মানুষ, তারচেয়ে বেশি পাচ্ছে সরকার তথা প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এআই নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব যুক্তি রাষ্ট্রগুলো দেখাচ্ছে, এর মধ্যে একটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন জালিয়াতি বা অন্যান্য ক্ষতির কারণ হতে পারে এআই। এর পেছনে সরকারগুলোর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চিন্তা থেকে থাকতে পারে।

এটা ঠিক, ১০ বছর পর পৃথিবী কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আমরা হয় তো কল্পনাও করতে পারব না। এরই মধ্যে কিছু নমুনা প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে এআই নিয়ন্ত্রিত বট নিয়োগ দিয়েছে বহু কারাখানা। লন্ডন শহরের ডিজাইন মিউজিয়ামে ২০২১ সালের ১৮ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত একটি পোর্ট্রেট প্রদর্শনী হয়েছিল। পোর্ট্রেটগুলো এঁকেছে আই-ডা, যাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম রোবট শিল্পী। হালের মডেল আইটানার কথা বলা যায়। গোলাপি চুল। টানা চোখ। চোখা নাক। পাতলা ঠোঁট। নজরকাড়া চেহারা। যাকে বলে আবেদনময়ী। ২৫ বছর বয়সী স্পেনের জনপ্রিয় মডেল। তবে আইটানা রক্ত-মাংসের মানুষ নয়। একজন এআই মডেল। ইনস্টাগ্রামে তার ফলোয়ার তিন লাখ ছাড়িয়েছে। প্রতি মাসে তার গড় আয় ১০ হাজার ডলারের ওপর। এখানেই শেষ নয়। সিনেমাকে বলা হয় সবচেয়ে ব্যয়বহুল শিল্পমাধ্যম। এআই এসে সেই ধারণাও পাল্টে দিচ্ছে। কোনো শুটিং সেট থাকবে না। প্রয়োজন পড়বে না বহু পারিশ্রমিক দাবি করা নায়ক/নায়িকা। এমনকি লাগবে না কোনো ক্যামেরাও। সিনেমার ইতিহাসই পাল্টে দিতে যাচ্ছে এআই। ব্রিটিশ রাজপরিবারের একটি ছবি এরই মধ্যে এআইয়ের তৈরি বলে স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এক সাংবাদিক আইনমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, এআই আইনের ফলে কী হবে? জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘‌এ আইনের ফলে কী হবে, সেটি আমাদের কাছেও জিজ্ঞাস্য। তার কারণ হচ্ছে, আমরা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করব। কিন্তু এ বিষয়টুকু আমি বলতে পারি যে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এবং সর্বক্ষেত্রে সেটা সংরক্ষণের জন্য, মানুষের সুবিধার জন্য এআইকে যাতে ব্যবহার করা যায়, সেই চেষ্টাই করব।’ আমরা আশা করব, আইনমন্ত্রী তার এ কথা রাখবেন।

হানযালা হান: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন