৮২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা

রাজস্ব আহরণে এনবিআরকে তৎপর হতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার বাজারে অস্থিতিশীলতা, ব্যাংক খাতে নানা সংকট, রফতানি বাণিজ্যে ঘাটতি, রেমিট্যান্স-স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে নেতিবাচক অভিঘাত পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। একটি দেশের অর্থনীতির ধারা সচ্ছল রাখতে অর্থায়নের উৎস খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অর্থায়নের প্রধান উৎস রাজস্ব। কিন্তু দেশে রাজস্ব আহরণ করা হয় শ্লথগতিতে এবং জনগোষ্ঠীর বিরাট একটা অংশ কর ফাঁকি দেয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ সংস্থান হওয়ার কথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর (প্রত্যক্ষ) থেকে। এছাড়া এনবিআরের পরোক্ষ কর বাবদ অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ থেকেও আয় করে সরকার। তাই বাজেট প্রণয়নের সময় অর্থ বিভাগ বাজেটের সঙ্গে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দেয়। ফলে বাজেটের আকার বড় হলে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও বড় হয়। সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সূত্রে জানা গেছে, ১০-১১ বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে ৮২ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে।

এনবিআরের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যেখানে একই সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। আর পুরো অর্থবছরে আদায়ের জন্য এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্য দেয়া হয়। সুতরাং ওই পাঁচ মাসে শুল্ক করসহ সব মিলিয়ে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। আবার গত অর্থবছরেও রাজস্ব আয়ে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ছিল।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সামর্থ্যের তুলনায় বেশি রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ফলে দেখা যায়, রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা প্রতি বছর বাড়তে থাকে, তবে সে তুলনায় আদায় করা সম্ভব হয় না। প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার দরুন এমন হয়ে থাকে। যেমন করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির গতি কমে গেছে। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাও দেশীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এর ওপর বিভিন্ন সেক্টরে শুল্ক কর ও ভ্যাট ছাড়, ভর্তুকি বা প্রণোদনা তো আছেই। এসব কারণে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বড় হলে শত চেষ্টা করেও অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয় না। আবার করযোগ্য অধিকাংশ নাগরিক কর ফাঁকি দেয়। এনবিআরের সক্ষমতা ও দক্ষতার প্রশ্নটি এখানে চলে আসে। ফলে প্রতি বছর রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেয়। সরকারের আয় কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে পরিচালন ব্যয়ে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এমন শ্লথগতিতে রাজস্ব আহরণ চলতে থাকলে কখনই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জন হবে না।

কর-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। রাজস্ব আয় বাড়াতে রাজস্ব খাতে বড় সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আহরণে উদ্যোগী হতে হবে। এনবিআরের তথ্যানুসারে, আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর—এ তিন খাতের মধ্যে কোনোটিতেই চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ছিল আয়কর খাতে। আয়কর খাতে ঘাটতির পরিমাণ ৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা। জুলাই-নভেম্বর সময়ে আয়কর আদায় হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্য ছিল ৪৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। কেন মানুষ আয়কর ফাঁকি দেয়, এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। কেন জনগণকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা যাচ্ছে না—এ বিষয় নিয়ে কাজ করা না গেলে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কখনই হবে না। 

এছাড়া মূল্যহ্রাসে অনেক সময়, বিশেষত রমজান মাস এলেই এনবিআরকে শুল্ক-কর বা ভ্যাট কমানোর নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর ফলে কেবল রাজস্ব আদায় কম হয়, বাজারদর কমে না। কারণ শুল্ক কমানোর ফলাফল পেতে কমপক্ষে ছয় মাস সময় লেগে যায়। কিন্তু উচ্চ দামের ফলে মানুষের ভোগ কমে আসে। এতে অর্থনীতি আরো চাপের মুখে পড়ে যায়। সুতরাং পরিকল্পনাবিদদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া দরকার। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য এসব জায়গায় এনবিআরের স্থির থাকাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

দেশের অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে যথাযথভাবে রাজস্ব আয় নিশ্চিতে মনোযোগী হতে হবে সরকারকে। এজন্য এনবিআরকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপমুক্ত করতে হবে, সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থার আলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। রাজস্ব আহরণে এনবিআরকে গতিশীল ভূমিকায় আনতে এ পদ্ধতিকে সহজীকরণের বিষয়ে কাজ করতে হবে। এছাড়া রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব নয় এমন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। সর্বোপরি এনবিআরকে এ বিষয়ে তৎপর হতে হবে। রাজস্ব ফাঁকি দেয়া ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন